মাহমুদুর রহমান মান্না
২২ তারিখে প্রেস কনফারেন্স করার পর থেকে একটি আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। অনেক জবাব পাচ্ছি, মতামত, সমালোচনা, আত্দসমালোচনা ইত্যাদি। একটি উদ্ধৃতি বা একজনের একটি মন্তব্য দিয়ে শুরু করি। বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত লেখক মন্তব্য করেছেন মাহমুদুর রহমান মান্না যদি সত্যিই একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন তাহলে বিএনপির হয়তো আখেরে লাভ হবে। তাদের জোটের সদস্য সংখ্যা বাড়বে। ১৮ দলের জোটের বদলে ১৯ দলীয় জোট তৈরি হবে। শূন্য+শূন্য+শূন্য = শূন্য। মান্নার দল এই শূন্যতার রাজনীতিতে যুক্ত হবে।
হাসব নাকি কাঁদব তাই ভাবছি। অনেকে আছেন_যারা নিজেদের সবজান্তা মনে করেন। আর এ কারণে সবকিছু না হোক মূল বিষয়টুকু, নির্যাসটুকু ভালো করে জানার চেষ্টাও করেন না। ২২ তারিখে যে সংবাদ সম্মেলন আমি করেছি সেখানে নাগরিক ঐক্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। ১ জুন ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনে আমরা একটি সমাবেশ করেছিলাম। প্রধানত ঢাকা সিটি করপোরেশনের উত্তরে যারা আমার সঙ্গে কাজ করেছিলেন তাদের ব্যাপক অংশ সেখানে যোগ দিয়েছিলেন। ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন কানায় কানায় ভর্তি ছিল। তাদের সবার একটি বক্তব্য ছিল, ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন আপাতত বন্ধ করা হয়েছে ঠিক, কিন্তু সে নির্বাচন তো দিতে হবে একদিন না একদিন, যতদিন পরই হোক। আমরা একটি চিন্তার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম, কাজকর্ম শুরু করেছিলাম। আমরা মনে করেছিলাম, নিছক দলবাজি নয়, একটি সত্যনিষ্ঠ দিক-নির্দেশনামূলক রাজনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলের ভিত্তিতে নয়, সৎ ও যোগ্যতার ভিত্তিতে ভোট দিব।
গত ৪০-৪২ বছরে বাংলাদেশের অগ্রগতি, অবস্থান, অবস্থা_ রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবে খুব সন্তোষজনক নয়। এমনিতে এশিয়ান টাইগার বলা হয় যেসব দেশকে তারা তো এগিয়ে গেছেই, এমনকি ভুটান, নেপালও অনেক ক্ষেত্রে আমাদের চেয়ে এগিয়ে। এটাই মানুষের কাছে বেশি উদ্বেগের কারণ হয়েছে। রাজনীতি সম্পর্কে এ জন্যই মানুষের একটা বিতৃষ্ণ ভাব জন্মেছে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিসহ সামগ্রিকভাবে আমাদের রাজনীতিতে একটি সংস্কৃতি চালু হয়ে গেছে_ সেটা হলো তোষামোদের সংস্কৃতি। নেতা যখন কথা বলছেন তখন দলের পক্ষে বলছেন, নেত্রীর পক্ষে বলছেন, কখনো আত্দসমালোচনামূলক কিছু বলছেন না। ওয়ান-ইলেভেনের পর মানুষ আশা করেছিল, দুটি বড় দলের মধ্যে বোধোদয় হবে। যে অমীমাংসেয় দ্বন্দ্বের কারণে ওয়ান-ইলেভেনের মতো ঘটনা ঘটেছে, সে রকম যেন ভবিষ্যতে না হয় এবং গণতন্ত্রের পথ যাতে তুলনামূলকভাবে মসৃণ হয় সে রকম সংস্কৃতি তারা চালু করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে গত সাড়ে তিন বছরের ইতিহাসে দেখা গেল এ সম্পর্ক দিন দিন আরও খারাপ হয়েছে এবং রাজনীতি একটি সাংঘর্ষিক দিকে চলে গেছে। খালেদা জিয়া সর্বশেষ সমাবেশে বলেছেন, যেহেতু সামনে রোজা তাই বড় ধরনের কোনো কর্মসূচি দেবেন না। রোজার পরে কর্মসূচি দেবেন এবং তা হবে সরকার পতনের কর্মসূচি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পাল্টা হুমকি দিয়ে বলেছে, এ ধরনের আন্দোলনের হুমকিতে তারা ভীত নয়, তারা রাজপথে দেখে নেবে। বিষয়টি তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? ইতোমধ্যে এ দুই দলের রাজনীতির কারণে 'এ' লেভেলের পরীক্ষার্থীদের রাত ১২টার সময় পরীক্ষা দিতে হয়েছে। অন্যান্য দু'একটি পরীক্ষাও ছুটির দিনে দিতে হয়েছে। হরতাল ডাকা হয়নি। কিন্তু সরকারি দলের আচরণে সারা দেশে হরতালের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিনা নোটিশে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা ফেরার সময় ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় দীর্ঘক্ষণ আটকে থেকেছে। সমাজ, ব্যক্তি, পারিবারিক জীবনে যেখানে রাজনৈতিক দলের শান্তি নিশ্চিত করার কথা, সেখানে তাদের আচরণে নাগরিকদের কষ্ট আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা খুবই দুঃখজনক এবং বলা যায়, দেশের জনগণ এ দুটি রাজনৈতিক দলের কাছে এখন জিম্মি হয়ে আছে। এরা জনগণের কথা শুনছে না বরং জনগণ তাদের কথা শুনতে বাধ্য হচ্ছে। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ওই সমাবেশে একটি বক্তব্য রেখেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে যেখানে যেখানে গেছেন, সেখানেই দেখেছেন সাধারণভাবে, মানুষ দুই নেত্রীর ওপর বিরক্ত। দুই দলের ওপর সন্তুষ্ট নয়। তিনি বলেছিলেন, মাহমুদুর রহমান মান্না যদি এ দুই দলের সংঘর্ষিক পরিস্থিতি বন্ধ করতে উদ্যোগ নিতে পারেন, তাদের বসাতে পারেন, কাজ করতে পারেন তাহলে সেটা ভালো হবে। আমি বলেছিলাম, তাদের দুজনকে বসাতে পারব সেটা বলা যাবে না। কারণ তারা দুজন যথেষ্ট পরিমাণে পরিপক্ব হয়েছেন রাজনৈতিকভাবে। রাজনীতি তারা ভালো বোঝেন। নিজেদের ভালো বোঝেন, দেশের ও দশের ভালো বোঝেন নিশ্চয়ই। কোন সময় কোন রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে সেটা তারা তাদের নিজের বিবেচনায় তাদের দলীয় বিবেচনায় গ্রহণ করবেন। আমার কথায় নয়। এটা কোনো বাচ্চা মেয়েকে বোঝানোর বিষয় নয়। তবে আমি এটা মনে করি, দেশে যেহেতু সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চা হচ্ছে এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য দুটি দলের মুখ্য ভূমিকা থাকা দরকার সেই হিসেবে বাংলাদেশে এটি দ্বিদলীয় পদ্ধতিতে গড়ে উঠেছে। দুই দলের একটি বিএনপি আরেকটি আওয়ামী লীগ। এ দুই দলের মধ্যে যত সুসম্পর্ক থাকবে, যত বেশি তারা সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চা করবেন দলের অভ্যন্তরে দলীয় গণতন্ত্র চর্চা করবেন তাতে দেশের কল্যাণ হবে। এটি ঠিক আমরা দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চা করতে পারছি না এবং সামগ্রিকভাবে দুই দলের রাজনীতি পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার সমঝোতার পরিবর্তে দিনের পর দিন সাংঘর্ষিক হয়ে যাচ্ছে। পরিণতি হচ্ছে দল বা দেশ তার কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন পাচ্ছে না এবং এককথায় বলা যেতে পারে, আমরা যতখানি এগুবার কথা ছিল তার চেয়ে বেশি পিছিয়ে যাচ্ছি।
সাংবাদিকদের অনেকে প্রশ্ন করেছিলেন, নবগঠিত এই সংগঠন, নাগরিক ঐক্য কি একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠবে? আমি প্রশ্নের জবাবে তাদের বলেছি, এটি প্রধানত নাগরিকদের একটি সংগঠন। ২২ তারিখে আমরা যখন কমিটি গঠন করেছিলাম তখন আমাদের সঙ্গে ঢাকা দক্ষিণের মেয়রপ্রার্থী ড. তুহিন মালিক উপস্থিত ছিলেন। এ রকম করে তিনিসহ দক্ষিণের আরও অনেকে যারা তার সঙ্গে রাজনীতিতে বা নির্বাচনে ছিলেন এমনকি বিগত দিনে যারা সমাজকর্মী ছিলেন তারা এসেছিলেন। শুধু উত্তরই নয়, উত্তর-দক্ষিণ মিলে একটি বিরাট কমিটি গঠন করা হয়েছিল। আমি জবাবে বলেছিলাম, আমরা একটি নাগরিক সংগঠন গঠন করছি, যারা অচলায়তন রাজনীতির ওপর আঘাত হানতে পারবে। কোনো সন্দেহ নেই নাগরিক ঐক্যের সামনে বড় বিবেচনার বিষয় গণতান্ত্রিক এবং মৌলিক অধিকার। এ দুটি শব্দ আমরা যখন বলি তার সঙ্গে রাজনীতি অঙ্গাঙ্গীভাবে এসে পড়ে। কিন্তু যে কোনো মানুষ যখন মৌলিক অধিকারের পক্ষে কথা বলে তার মানে এই নয় যে, সে একটি পার্টি করে। সে যখন গণতন্ত্রের কথা বলে তার মানে সে পার্টি করে এ রকম কোনো বিষয় নেই। অতএব আমরা যে যাত্রা করছি, এটি কোনো দল করার বিবেচনা থেকে করছি না।
একজন বন্ধু বলেছেন, মাহমুদুর রহমান মান্না একটি নতুন দল গঠনের প্রস্তুতিপর্ব হিসেবে সমাবেশ ঘটিয়েছেন এবং নতুন দল গঠিত হলে প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক এবং প্রবীণ সাংবাদিক এ বি এম মূসা দলটির উপদেষ্টা হতে পারেন। কতখানি ভ্রান্ত ধারণা থেকে এই কথাগুলো বলা হলো তা সহজেই বোধগম্য। কারণ ব্যারিস্টার রফিক-উল হক সবসময় এ কথা বলছেন, তিনি কখনো কোনো রাজনৈতিক দল করবেন না। তার এ রকম কোনো ভাবনা নেই। আর যিনি বা যারা এ কথাগুলো বলছেন তার অবগতির জন্য বলছি, এ বি এম মূসাকে ব্যক্তিগতভাবে সমাবেশ শেষে সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এটি কি কোনো রাজনৈতিক দল হচ্ছে? এটি কি ভবিষ্যতে কোনো নির্বাচন করবে? তখন তিনি বলেছিলেন, যতদূর আমাকে বলা হয়েছে, আমি ততদূর জানি। এর বেশি আমি বলতে পারব না। কারণ আমি এর গঠনের ভেতরে এ রকমভাবে ছিলাম না। আর একটি রাজনৈতিক দল গঠনের উপদেষ্টা হিসেবে আমি এখানে আসিনি। বিষয়টি খুবই স্পষ্ট যে, তারা কেউ একটি রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্দেশ্যে আমাদের সমাবেশে আসেননি। যারা এ রকম বলছেন তারা মূলত নাগরিক আন্দোলন সম্পর্কে বিভ্রান্তিতে ভুগছেন। তাদের কোনো কোনো বন্ধু হয়তো দেশে-বিদেশে আছেন, তারা হয়তো বলছেন এটি কোনো রাজনৈতিক দল হিসেবে দাঁড়াতে পারে। আমি এ কথা অস্বীকার করব না, এই কারণে যে, আমি এটি খেয়াল করছি এবং যারা এ কথাগুলো বলছেন তাদের বলছি, এটি একটি বাস্তবতা। ব্যারিস্টার রফিক ঠিক কথা বলেছেন। দুটি দল এবং দলের নেতৃত্বের কাছে আমরা প্রায় জিম্মি হয়ে পড়েছি। মানুষ হয়তো অনেক কিছু পছন্দ করতে পারছে না। কিন্তু মানা ছাড়া কোনো উপায় নেই। হয়তো মানুষ ভেতরে ভেতরে এ রকম আশঙ্কায় আছে যে, এ দুই দল যে রকম রাজনীতি করছে তার চেয়ে ভালো দল যদি দাঁড়ায় বা ভালো কোনো শক্তি দাঁড়ায় তবে তার পক্ষে আমরা থাকব। তার প্রমাণ মানুষ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দিয়েছে, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে দিয়েছে এবং আমি দাবি করছি যদি ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন হতো তাহলে হয়তো এখানে মানুষ এ ধরনের একটি রায় দিতে পারত। প্রশ্ন হচ্ছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সময় মানুষ যখন এ রকম বলছে, সে ধরনের বিষয় আগামী জাতীয় নির্বাচনে হতে পারে কি? এটি দেখার বিষয়। জাতীয় নির্বাচনে এমন হয় যে, মার্কা থাকে দুটি বড় দল থেকে। তার বাইরে তো আর কেউ নেই। অতএব এ দুটির মধ্যে বিবেচনাও থাকে। 'এ বি'র বাইরে যদি সে রকম কোনো শক্তি আসতে পারে, তাহলে কি মানুষ অন্য কোনো কিছু ভাববে? মানুষের ভাবনার ওপর কেউ কি বাজি রাখতে পারবেন? মানুষের ভাবনা কি কেউ জোর করে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে পারবেন? মানুষ যদি এতকিছুর পর সত্যিই এই দুই দলের মধ্যে পরিবর্তন দেখতে চায়, তাহলে তাই হবে। আমি খুব স্পষ্ট করে বলছি নাগরিক আন্দোলন এবং নাগরিক ঐক্যের প্রথম বিবেচনা হচ্ছে এই দুটি দল যেন অভ্যন্তরীণভাবে আরও বেশি গণতান্ত্রিক হয়, আরও বেশি পরস্পরের প্রতি সহনশীল হয়। আরও বেশি শ্রদ্ধাশীল হয়। ভিন্নমত ও পরমত সহ্য করার মতো মানসিকতা যেন তাদের থাকে সেদিকে যেন তারা বেশি দৃষ্টি দেওয়ার চেষ্টা করেন। যদি তারা ভালো হয়ে যান, আরও উন্নত হন, মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হন, তবে মাহমুদুর রহমান মান্না বা ব্যারিস্টার রফিক কিংবা এ বি এম মূসা চাইলেই কি আরেকটি দল বা শক্তি গড়ে তুলতে পারবেন? গায়ের জোরে রাজনীতি করা যায় না। কিন্তু যদি দুই দল ব্যর্থ হয় তাহলে সবসময় অন্য একটি কিছু হওয়ার বস্তুগত অবস্থান তৈরি হয়ে যে থাকে এই কথা যে কোনো বিজ্ঞ মানুষের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বন্ধুদের কেউ কেউ (সবাইকে বন্ধু বলা হয়তো আমার জন্য বেয়াদবির শামিল হবে) গুরুজন অথবা মুরবি্বদের কেউ কেউ আমাকে এ রকম একটি উপদেশ দেওয়ার চেষ্টা করছেন যে আওয়ামী লীগকে শোধরাতে হলে দলের ভেতরে বসেই কঠোর প্রতিজ্ঞা নিয়ে দক্ষিণপন্থি সুবিধাবাদী কায়েমি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। সুন্দর প্রস্তাব। কিন্তু এটা কি সম্ভব? কতখানি সম্ভব? (আগামী বুধবারের সংখ্যায় এর ওপর লিখব)।
লেখক : রাজনীতিক
ই-মেইল : mrmanna51@yahoo.com
২২ তারিখে প্রেস কনফারেন্স করার পর থেকে একটি আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। অনেক জবাব পাচ্ছি, মতামত, সমালোচনা, আত্দসমালোচনা ইত্যাদি। একটি উদ্ধৃতি বা একজনের একটি মন্তব্য দিয়ে শুরু করি। বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত লেখক মন্তব্য করেছেন মাহমুদুর রহমান মান্না যদি সত্যিই একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন তাহলে বিএনপির হয়তো আখেরে লাভ হবে। তাদের জোটের সদস্য সংখ্যা বাড়বে। ১৮ দলের জোটের বদলে ১৯ দলীয় জোট তৈরি হবে। শূন্য+শূন্য+শূন্য = শূন্য। মান্নার দল এই শূন্যতার রাজনীতিতে যুক্ত হবে।
হাসব নাকি কাঁদব তাই ভাবছি। অনেকে আছেন_যারা নিজেদের সবজান্তা মনে করেন। আর এ কারণে সবকিছু না হোক মূল বিষয়টুকু, নির্যাসটুকু ভালো করে জানার চেষ্টাও করেন না। ২২ তারিখে যে সংবাদ সম্মেলন আমি করেছি সেখানে নাগরিক ঐক্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। ১ জুন ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনে আমরা একটি সমাবেশ করেছিলাম। প্রধানত ঢাকা সিটি করপোরেশনের উত্তরে যারা আমার সঙ্গে কাজ করেছিলেন তাদের ব্যাপক অংশ সেখানে যোগ দিয়েছিলেন। ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন কানায় কানায় ভর্তি ছিল। তাদের সবার একটি বক্তব্য ছিল, ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন আপাতত বন্ধ করা হয়েছে ঠিক, কিন্তু সে নির্বাচন তো দিতে হবে একদিন না একদিন, যতদিন পরই হোক। আমরা একটি চিন্তার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম, কাজকর্ম শুরু করেছিলাম। আমরা মনে করেছিলাম, নিছক দলবাজি নয়, একটি সত্যনিষ্ঠ দিক-নির্দেশনামূলক রাজনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলের ভিত্তিতে নয়, সৎ ও যোগ্যতার ভিত্তিতে ভোট দিব।
গত ৪০-৪২ বছরে বাংলাদেশের অগ্রগতি, অবস্থান, অবস্থা_ রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবে খুব সন্তোষজনক নয়। এমনিতে এশিয়ান টাইগার বলা হয় যেসব দেশকে তারা তো এগিয়ে গেছেই, এমনকি ভুটান, নেপালও অনেক ক্ষেত্রে আমাদের চেয়ে এগিয়ে। এটাই মানুষের কাছে বেশি উদ্বেগের কারণ হয়েছে। রাজনীতি সম্পর্কে এ জন্যই মানুষের একটা বিতৃষ্ণ ভাব জন্মেছে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিসহ সামগ্রিকভাবে আমাদের রাজনীতিতে একটি সংস্কৃতি চালু হয়ে গেছে_ সেটা হলো তোষামোদের সংস্কৃতি। নেতা যখন কথা বলছেন তখন দলের পক্ষে বলছেন, নেত্রীর পক্ষে বলছেন, কখনো আত্দসমালোচনামূলক কিছু বলছেন না। ওয়ান-ইলেভেনের পর মানুষ আশা করেছিল, দুটি বড় দলের মধ্যে বোধোদয় হবে। যে অমীমাংসেয় দ্বন্দ্বের কারণে ওয়ান-ইলেভেনের মতো ঘটনা ঘটেছে, সে রকম যেন ভবিষ্যতে না হয় এবং গণতন্ত্রের পথ যাতে তুলনামূলকভাবে মসৃণ হয় সে রকম সংস্কৃতি তারা চালু করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে গত সাড়ে তিন বছরের ইতিহাসে দেখা গেল এ সম্পর্ক দিন দিন আরও খারাপ হয়েছে এবং রাজনীতি একটি সাংঘর্ষিক দিকে চলে গেছে। খালেদা জিয়া সর্বশেষ সমাবেশে বলেছেন, যেহেতু সামনে রোজা তাই বড় ধরনের কোনো কর্মসূচি দেবেন না। রোজার পরে কর্মসূচি দেবেন এবং তা হবে সরকার পতনের কর্মসূচি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পাল্টা হুমকি দিয়ে বলেছে, এ ধরনের আন্দোলনের হুমকিতে তারা ভীত নয়, তারা রাজপথে দেখে নেবে। বিষয়টি তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? ইতোমধ্যে এ দুই দলের রাজনীতির কারণে 'এ' লেভেলের পরীক্ষার্থীদের রাত ১২টার সময় পরীক্ষা দিতে হয়েছে। অন্যান্য দু'একটি পরীক্ষাও ছুটির দিনে দিতে হয়েছে। হরতাল ডাকা হয়নি। কিন্তু সরকারি দলের আচরণে সারা দেশে হরতালের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিনা নোটিশে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা ফেরার সময় ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় দীর্ঘক্ষণ আটকে থেকেছে। সমাজ, ব্যক্তি, পারিবারিক জীবনে যেখানে রাজনৈতিক দলের শান্তি নিশ্চিত করার কথা, সেখানে তাদের আচরণে নাগরিকদের কষ্ট আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা খুবই দুঃখজনক এবং বলা যায়, দেশের জনগণ এ দুটি রাজনৈতিক দলের কাছে এখন জিম্মি হয়ে আছে। এরা জনগণের কথা শুনছে না বরং জনগণ তাদের কথা শুনতে বাধ্য হচ্ছে। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ওই সমাবেশে একটি বক্তব্য রেখেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে যেখানে যেখানে গেছেন, সেখানেই দেখেছেন সাধারণভাবে, মানুষ দুই নেত্রীর ওপর বিরক্ত। দুই দলের ওপর সন্তুষ্ট নয়। তিনি বলেছিলেন, মাহমুদুর রহমান মান্না যদি এ দুই দলের সংঘর্ষিক পরিস্থিতি বন্ধ করতে উদ্যোগ নিতে পারেন, তাদের বসাতে পারেন, কাজ করতে পারেন তাহলে সেটা ভালো হবে। আমি বলেছিলাম, তাদের দুজনকে বসাতে পারব সেটা বলা যাবে না। কারণ তারা দুজন যথেষ্ট পরিমাণে পরিপক্ব হয়েছেন রাজনৈতিকভাবে। রাজনীতি তারা ভালো বোঝেন। নিজেদের ভালো বোঝেন, দেশের ও দশের ভালো বোঝেন নিশ্চয়ই। কোন সময় কোন রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে সেটা তারা তাদের নিজের বিবেচনায় তাদের দলীয় বিবেচনায় গ্রহণ করবেন। আমার কথায় নয়। এটা কোনো বাচ্চা মেয়েকে বোঝানোর বিষয় নয়। তবে আমি এটা মনে করি, দেশে যেহেতু সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চা হচ্ছে এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য দুটি দলের মুখ্য ভূমিকা থাকা দরকার সেই হিসেবে বাংলাদেশে এটি দ্বিদলীয় পদ্ধতিতে গড়ে উঠেছে। দুই দলের একটি বিএনপি আরেকটি আওয়ামী লীগ। এ দুই দলের মধ্যে যত সুসম্পর্ক থাকবে, যত বেশি তারা সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চা করবেন দলের অভ্যন্তরে দলীয় গণতন্ত্র চর্চা করবেন তাতে দেশের কল্যাণ হবে। এটি ঠিক আমরা দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চা করতে পারছি না এবং সামগ্রিকভাবে দুই দলের রাজনীতি পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার সমঝোতার পরিবর্তে দিনের পর দিন সাংঘর্ষিক হয়ে যাচ্ছে। পরিণতি হচ্ছে দল বা দেশ তার কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন পাচ্ছে না এবং এককথায় বলা যেতে পারে, আমরা যতখানি এগুবার কথা ছিল তার চেয়ে বেশি পিছিয়ে যাচ্ছি।
সাংবাদিকদের অনেকে প্রশ্ন করেছিলেন, নবগঠিত এই সংগঠন, নাগরিক ঐক্য কি একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠবে? আমি প্রশ্নের জবাবে তাদের বলেছি, এটি প্রধানত নাগরিকদের একটি সংগঠন। ২২ তারিখে আমরা যখন কমিটি গঠন করেছিলাম তখন আমাদের সঙ্গে ঢাকা দক্ষিণের মেয়রপ্রার্থী ড. তুহিন মালিক উপস্থিত ছিলেন। এ রকম করে তিনিসহ দক্ষিণের আরও অনেকে যারা তার সঙ্গে রাজনীতিতে বা নির্বাচনে ছিলেন এমনকি বিগত দিনে যারা সমাজকর্মী ছিলেন তারা এসেছিলেন। শুধু উত্তরই নয়, উত্তর-দক্ষিণ মিলে একটি বিরাট কমিটি গঠন করা হয়েছিল। আমি জবাবে বলেছিলাম, আমরা একটি নাগরিক সংগঠন গঠন করছি, যারা অচলায়তন রাজনীতির ওপর আঘাত হানতে পারবে। কোনো সন্দেহ নেই নাগরিক ঐক্যের সামনে বড় বিবেচনার বিষয় গণতান্ত্রিক এবং মৌলিক অধিকার। এ দুটি শব্দ আমরা যখন বলি তার সঙ্গে রাজনীতি অঙ্গাঙ্গীভাবে এসে পড়ে। কিন্তু যে কোনো মানুষ যখন মৌলিক অধিকারের পক্ষে কথা বলে তার মানে এই নয় যে, সে একটি পার্টি করে। সে যখন গণতন্ত্রের কথা বলে তার মানে সে পার্টি করে এ রকম কোনো বিষয় নেই। অতএব আমরা যে যাত্রা করছি, এটি কোনো দল করার বিবেচনা থেকে করছি না।
একজন বন্ধু বলেছেন, মাহমুদুর রহমান মান্না একটি নতুন দল গঠনের প্রস্তুতিপর্ব হিসেবে সমাবেশ ঘটিয়েছেন এবং নতুন দল গঠিত হলে প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক এবং প্রবীণ সাংবাদিক এ বি এম মূসা দলটির উপদেষ্টা হতে পারেন। কতখানি ভ্রান্ত ধারণা থেকে এই কথাগুলো বলা হলো তা সহজেই বোধগম্য। কারণ ব্যারিস্টার রফিক-উল হক সবসময় এ কথা বলছেন, তিনি কখনো কোনো রাজনৈতিক দল করবেন না। তার এ রকম কোনো ভাবনা নেই। আর যিনি বা যারা এ কথাগুলো বলছেন তার অবগতির জন্য বলছি, এ বি এম মূসাকে ব্যক্তিগতভাবে সমাবেশ শেষে সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এটি কি কোনো রাজনৈতিক দল হচ্ছে? এটি কি ভবিষ্যতে কোনো নির্বাচন করবে? তখন তিনি বলেছিলেন, যতদূর আমাকে বলা হয়েছে, আমি ততদূর জানি। এর বেশি আমি বলতে পারব না। কারণ আমি এর গঠনের ভেতরে এ রকমভাবে ছিলাম না। আর একটি রাজনৈতিক দল গঠনের উপদেষ্টা হিসেবে আমি এখানে আসিনি। বিষয়টি খুবই স্পষ্ট যে, তারা কেউ একটি রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্দেশ্যে আমাদের সমাবেশে আসেননি। যারা এ রকম বলছেন তারা মূলত নাগরিক আন্দোলন সম্পর্কে বিভ্রান্তিতে ভুগছেন। তাদের কোনো কোনো বন্ধু হয়তো দেশে-বিদেশে আছেন, তারা হয়তো বলছেন এটি কোনো রাজনৈতিক দল হিসেবে দাঁড়াতে পারে। আমি এ কথা অস্বীকার করব না, এই কারণে যে, আমি এটি খেয়াল করছি এবং যারা এ কথাগুলো বলছেন তাদের বলছি, এটি একটি বাস্তবতা। ব্যারিস্টার রফিক ঠিক কথা বলেছেন। দুটি দল এবং দলের নেতৃত্বের কাছে আমরা প্রায় জিম্মি হয়ে পড়েছি। মানুষ হয়তো অনেক কিছু পছন্দ করতে পারছে না। কিন্তু মানা ছাড়া কোনো উপায় নেই। হয়তো মানুষ ভেতরে ভেতরে এ রকম আশঙ্কায় আছে যে, এ দুই দল যে রকম রাজনীতি করছে তার চেয়ে ভালো দল যদি দাঁড়ায় বা ভালো কোনো শক্তি দাঁড়ায় তবে তার পক্ষে আমরা থাকব। তার প্রমাণ মানুষ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দিয়েছে, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে দিয়েছে এবং আমি দাবি করছি যদি ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন হতো তাহলে হয়তো এখানে মানুষ এ ধরনের একটি রায় দিতে পারত। প্রশ্ন হচ্ছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সময় মানুষ যখন এ রকম বলছে, সে ধরনের বিষয় আগামী জাতীয় নির্বাচনে হতে পারে কি? এটি দেখার বিষয়। জাতীয় নির্বাচনে এমন হয় যে, মার্কা থাকে দুটি বড় দল থেকে। তার বাইরে তো আর কেউ নেই। অতএব এ দুটির মধ্যে বিবেচনাও থাকে। 'এ বি'র বাইরে যদি সে রকম কোনো শক্তি আসতে পারে, তাহলে কি মানুষ অন্য কোনো কিছু ভাববে? মানুষের ভাবনার ওপর কেউ কি বাজি রাখতে পারবেন? মানুষের ভাবনা কি কেউ জোর করে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে পারবেন? মানুষ যদি এতকিছুর পর সত্যিই এই দুই দলের মধ্যে পরিবর্তন দেখতে চায়, তাহলে তাই হবে। আমি খুব স্পষ্ট করে বলছি নাগরিক আন্দোলন এবং নাগরিক ঐক্যের প্রথম বিবেচনা হচ্ছে এই দুটি দল যেন অভ্যন্তরীণভাবে আরও বেশি গণতান্ত্রিক হয়, আরও বেশি পরস্পরের প্রতি সহনশীল হয়। আরও বেশি শ্রদ্ধাশীল হয়। ভিন্নমত ও পরমত সহ্য করার মতো মানসিকতা যেন তাদের থাকে সেদিকে যেন তারা বেশি দৃষ্টি দেওয়ার চেষ্টা করেন। যদি তারা ভালো হয়ে যান, আরও উন্নত হন, মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হন, তবে মাহমুদুর রহমান মান্না বা ব্যারিস্টার রফিক কিংবা এ বি এম মূসা চাইলেই কি আরেকটি দল বা শক্তি গড়ে তুলতে পারবেন? গায়ের জোরে রাজনীতি করা যায় না। কিন্তু যদি দুই দল ব্যর্থ হয় তাহলে সবসময় অন্য একটি কিছু হওয়ার বস্তুগত অবস্থান তৈরি হয়ে যে থাকে এই কথা যে কোনো বিজ্ঞ মানুষের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বন্ধুদের কেউ কেউ (সবাইকে বন্ধু বলা হয়তো আমার জন্য বেয়াদবির শামিল হবে) গুরুজন অথবা মুরবি্বদের কেউ কেউ আমাকে এ রকম একটি উপদেশ দেওয়ার চেষ্টা করছেন যে আওয়ামী লীগকে শোধরাতে হলে দলের ভেতরে বসেই কঠোর প্রতিজ্ঞা নিয়ে দক্ষিণপন্থি সুবিধাবাদী কায়েমি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। সুন্দর প্রস্তাব। কিন্তু এটা কি সম্ভব? কতখানি সম্ভব? (আগামী বুধবারের সংখ্যায় এর ওপর লিখব)।
লেখক : রাজনীতিক
ই-মেইল : mrmanna51@yahoo.com