মাহমুদুর রহমান মান্না
ক্ষমতাসীনদের আচরণ ও উচ্চারণে কার্যকর গণতন্ত্র-পরমতসহিষ্ণুতার প্রচণ্ড অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে, এ অভিমতের বিষয়ে বোধকরি অনেকেই সহমত পোষণ করবেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে ৪১ বছর হয়ে গেল। এ সময়ের পর্যালোচনায় গেলে দেখা যাবে, আমরা গণতন্ত্র পেয়েছি অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যা পেয়েছি তা হচ্ছে নির্বাচন। বলা যায়, ভোটের অধিকার পেয়েছি। বারবার এর প্রয়োগ হচ্ছে। আমরা এই নির্বাচনকেই মনে করছি গণতন্ত্র_ নির্বাচিত সরকার থাকা মানেই গণতন্ত্র থাকা। এ ভূমিকা এ কারণে দেওয়া যে এ বিষয়টি স্পষ্ট না থাকলে পরবর্তী যে সংকট_ গণতন্ত্রের যে সংকট সেটা ঠিকভাবে বোঝা যাবে না। স্বাধীন দেশের একেবারে যাত্রা থেকেই যারা ক্ষমতায় ছিলেন বা রয়েছেন, পরমতের প্রতি তাদের সহিষ্ণু মনোভাবের বড়ই অভাব দেখছি। যার জন্য স্বাধীনতা অর্জনের চার বছর যেতে না যেতেই বঙ্গবন্ধুকে সারাজীবনের লালিত স্বপ্ন ও সংগ্রামের অর্জন সংসদীয় গণতন্ত্র ভেঙে একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় যেতে হয়েছে। সেই একদলীয় ব্যবস্থা থেকে আবার আমাদের উত্তরণ ঘটেছে বহুদলীয় ব্যবস্থায়। তবে এটা গণতান্ত্রিকভাবে ঘটেনি, বরং হয়েছে সঙ্গিনের খোঁচায়। তাতে একদলীয় ব্যবস্থা বিদায় নিয়েছে, কিন্তু এক ব্যক্তির শাসন_ রাষ্ট্রপতির শাসনে পরিবর্তন হয়নি।
এই যে এত বড় পরিবর্তন, যা অভিহিত হয় ঐতিহাসিক হিসেবে, তার পেছনে কতটা রাজনীতি-সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি, সব মিলিয়ে আমাদের কী ভুল ছিল, কতটা ভুল ছিল, ভুল হয়ে থাকলে কেন হয়েছিল, শুদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়া সঠিক ছিল কি-না_ এসব মূল্যায়িত হওয়া তো দূরের কথা, এমনকি তা নিয়ে মুক্তমনে আলোচনাও হয়নি। আমি বলতে চাইছি, মত ও পথের ভিন্নতা এবং তার মিথস্ক্রিয়া, যা দিয়ে গণতন্ত্র নির্মিত হয়_ সেটা বাংলাদেশে কখনও হয়নি। গণতন্ত্র কেবলই একটি শাসনব্যবস্থা নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মূল্যবোধ এবং নীতি ও নৈতিকতা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে, কিন্তু সেই সংস্কৃতির বিষয়ে এভাবে আমরা কখনও চর্চা করিনি। দিনে দিনে রাজনীতিতে তাই পরমতসহিষ্ণুতার বদলে অসহিষ্ণুতা প্রকট। ভিন্নমতকে যে কোনো প্রকারে পরাস্ত করার প্রবণতা দেখা দিয়েছে এবং যা শেষ পর্যন্ত সাংস্কৃতিক রূপ নিয়েছে। আমরা এত অধৈর্য হয়ে পড়েছি যে সংবাদপত্র কিংবা বেতার-টেলিভিশনের যে স্বাধীনতার কথা মুখে বলছি, তার মানে কী তা বুঝতে পারছি না কিংবা সে চেষ্টাও করছি না। সংবাদপত্র-টেলিভিশনের মতো গণমাধ্যমে যা কিছু ভিন্নমত প্রকাশ করা হচ্ছে তার প্রতিও আমরা রুষ্ট হয়ে পড়ছি।
সংসদীয় ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের বিমূর্ত, ব্যক্তিকৃত যে রূপ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী_ তিনি পর্যন্ত অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছেন। ইতিপূর্বে তিনি দু'একবার বক্তৃতায় টেলিভিশন টক শো যারা করেন তাদের কঠোর সমালোচনা করেছেন এই বলে যে, তারা গভীর রাতে ছোট বাক্সে নিজেদের পাণ্ডিত্য দেখান, কিন্তু কোথাও জনগণের মতামত যাচাই করার ক্ষমতা রাখেন না। কোনো এলাকায় ভোটে দাঁড়ালে তাদের জামানত থাকবে না। তিনি এমনকি কোথাও কোথাও তাদের এক-এগারোর সমর্থক হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন। কী অবাক ব্যাপার। দেশের ১৬ কোটি মানুষ তো ভোটে দাঁড়াবে না। তাদের সবাই নির্বাচনে দাঁড়ানোর কথা ভাবেও না। তার মানে কি এই যে, তারা গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি, সরকার, বিরোধী দল, রাজনীতি_ এসব নিয়ে কথা বলতে পারবে না? আর ভোটে জয়ী হওয়াই কি সব? পৃথিবীর যত বড় বিজ্ঞানী কিংবা কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক, তারা ক'জন ভোটে দাঁড়িয়েছেন? বিজ্ঞানীদের যে আবিষ্কার, যা মানবজাতিকে আলোকিত করে চলেছে সেসব কি ভোটে দেওয়ার প্রশ্ন আসে? পৃথিবী যে সূর্যের চারদিকে ঘোরে সেটা যদি বাংলাদেশ বা অন্যত্র জনতার ভোটে ফেল করে তাহলে কি মিথ্যা হয়ে যাবে? আমি বলতে চাইছি, সত্য কখনও সংখ্যালঘিষ্ঠ বা সংখ্যাগরিষ্ঠের ওপর নির্ভর করে না। জ্ঞানচর্চার সঙ্গে ভোটের কোনো সম্পর্ক নেই।
প্রধানমন্ত্রী চার-পাঁচ দিন আগেও যারা টক শো করেন তাদের আরেক হাত নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এরা সরকারের অর্জনের কথা বলে না। কেবল সমালোচনা করে। মিথ্যা প্রচার করে। তিনি এবং তার সরকার গ্রামের দরিদ্রদের জন্য, বঞ্চিত মানুষের জন্য কাজ করে চলেছেন। তাদের কিছু দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এই 'টক শো'ওয়ালারা কিছু পায় না, তাই যত রাগ। এ জন্যই সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করে। আবার কিন্তু সেই ধৈর্য পরীক্ষার প্রশ্ন এসে যায়। টক শোতে যারা যান তারা সাধারণত তাদের দায়িত্ববোধ থেকে কথা বলেন। একটা রেওয়াজ আমরা দেখেছি_ এ ধরনের অনুষ্ঠানের অতিথি হিসেবে একজন সরকারি দল এবং একজন বিরোধী দলের নেতা বা বুদ্ধিজীবী থাকবেন। আজকাল সে রেওয়াজ মানা যাচ্ছে না। কারণ সরকারি দলের লোকজন টেলিভিশনে টক শোতে আসতে তেমন আগ্রহ দেখান না। আমার কথা হলো, সরকার দুটি কাজ করতে পারে। এক. এ পর্যন্ত টক শোতে আলোচনায় কী কী মিথ্যাচার হয়েছে তা উল্লেখ করে তার সত্যায়িত বিবরণ গণমাধ্যমে প্রকাশ করা। দুই. সরকারি দলের নেতারা টেলিভিশন টক শোতে আরও বেশি করে আসবেন এবং নিজেদের কথা বলবেন। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, আমার পরিচালনায় উপস্থিত দু'জন অতিথি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছেন, তারা কোনোদিন সরকারি কোনো বিশেষ সুবিধা নেননি। এটা তারা চাননি এবং চাইবেনও না। সরকার এ ধরনের বিশেষ কী কী সুবিধা, অনুকম্পা, টক শোর অতিথিদের দিয়েছে এবং পরে যা প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে ক্ষেপেছে, তার কোনো বিবরণ দিতে পারবে কি?
এতসব কথা এসে গেল কেবল একটি কথা বলার উপক্রমণিকা হিসেবে। ৩ জুন জাতীয় সংসদে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একটি বক্তব্যের ওপর একটি ঝড় বয়ে গেছে। ভয়ানকভাবে ক্ষিপ্ত একজন সাবেক মন্ত্রী, একাধিক সিনিয়র সংসদ সদস্য এবং তখন সংসদের স্পিকারের দায়িত্ব পালনরত আলী আশরাফ এ বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা বলতে চেয়েছেন, টিআইবির আলোচনায় বক্তব্যের মাধ্যমে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ভোটারদের অবমাননা করেছেন।
গড়পড়তা সংসদ সদস্যদের চোর-ডাকাত বলা নিশ্চয়ই ঠিক নয়। কিন্তু ভোটে জিতে কোনো কোনো সাংসদ কি চুরি-ডাকাতি করতে পারেন না? এটা ঘটলে তাদের চোর বলা হলে কি ভোটারদের অপমান করা হবে? কোনো কোনো সংসদ সদস্য সেখানেই থেমে থাকেননি। তারা এ বক্তব্যকে গণতন্ত্র ও সংসদের ওপর আঘাত হিসেবে অভিহিত করেছেন। তারা এমনও বলেছেন, যেসব বুদ্ধিজীবী সরকারের সমালোচনা করেন তাদের আয়ের উৎস কী তা খতিয়ে দেখুন। এক-এগারোতে তারা কী করেছেন, তা আমাদের জানা আছে। একজন শিক্ষক এত দামি গাড়িতে কী করে চড়েন? নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকলে তাদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। অনির্বাচিত সরকার থাকলে তারা পদ পান। স্পিকারের দায়িত্ব পালনকারী আলী আশরাফ সংসদের এ বক্তব্যকে যথার্থ মনে করেন। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের আকাশে কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে। সংসদ অবমাননার মাধ্যমে দেশের জনগণ ও সংবিধানের অবমাননা করা হচ্ছে। এতে সাংসদদের বিশেষ অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে। সে জন্য আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে বিশেষ অধিকার কমিটির মাধ্যমে নোটিশ করে আমরা এ সংসদে তলব করতে পারি। একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। তাকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। সংসদের অবমাননা করার অধিকার কারও নেই।
পাঠক, যদি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ঢালাওভাবে সাংসদদের চোর-ডাকাত বলতেন তাহলে নিশ্চয়ই তার বিরোধিতা করতাম। আলোকিত মানুষ সৃষ্টিতে অবদান রাখার জন্য নিশ্চয়ই তাকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু শ্রদ্ধা করি বলেই কারও চরিত্রহনন কিংবা চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার করে গালাগাল করতে পারেন না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাস্তবে ঘটনাটা কী?
সমকাল ও প্রথম আলোতে সংসদে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বক্তব্য নিয়ে যেদিন আলোচনা হয়েছে সেদিনই এ দুটি পত্রিকার প্রতিবেদকরা তার সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি তাদের জানান, দুর্নীতি কী তা বোঝাতে গিয়ে টিআইবির আলোচনায় বলেছেন, চোর যে চুরি করে, ডাকাত যে ডাকাতি করে সেটা কি দুর্নীতি? আমার ধারণা, এটা দুর্নীতি নয়। কারণ তাদের কোনো নীতিই নেই। সুতরাং দুর্নীতি সেই মানুষটি করে যার নীতি আছে। একটা উদাহরণ দিই। যদি একজন মন্ত্রী এই বলে শপথ নেন যে তিনি শত্রু-মিত্র ভেদাভেদ না করে সবার প্রতি সমান বিচার করবেন কিন্তু পরে সেটি না করেন, সেটা হবে দুর্নীতি।
তিনি বলেন, আলোচনায় সাংসদ শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি।
এরপর সংসদ কী বলবে? ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে নিয়ে সংসদে আলোচনা ঠিক হয়নি বলে অভিমত দিয়েছেন। তবে সেটা বলা হয়েছে সংসদের বাইরে। সংসদে ৩ জুন যারা আলোচনা করেছেন তারা এ ধরনের মন্তব্য করার আগে একটু কি খতিয়ে দেখতে পারতেন না যে তিনি কী বলেছেন? এ কাজ কি যোগাযোগের আধুুনিক তথ্যপ্রযুক্তি যাদের হাতে তাদের জন্য কঠিন কিছু ছিল? উগ্র আবেগের বশে কিংবা ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে তারা যা বলেছেন তাতেই তো সংসদকে খাটো করা হয়েছে।
মাহমুদুর রহমান মান্না : রাজনীতিক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন