মঙ্গলবার, ১২ জুন, ২০১২

আবার গণতন্ত্র ও নাগরিক আন্দোলন নিয়ে কথা

মাহমুদুর রহমান মান্না


নাগরিক আন্দোলন বা সিভিল সোসাইটির আন্দোলনের কথা বলা হচ্ছে কেন? আমি একটি উদাহরণ দেই। আমার ছেলে এ বছর এ-লেভেল পরীক্ষা দিয়েছে। সবাই জানেন হরতালের কারণে এ-লেভেলের ছাত্রছাত্রীদের ছুটির দিন রাত ১২টার সময় পরীক্ষা দিতে হয়েছে। আমি কয়েকজনকে প্রশ্ন করেছি_ কেন এমন হবে?

এক নদী রক্ত সাঁতরিয়ে আমরা যে দেশ স্বাধীন করেছি সে দেশে গভীর রাতে পরীক্ষা অনুষ্ঠানের মতো কাজ হবে কেন? আমরা তো কোনো অপকর্ম করিনি? আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করেছেন শ্রোতারা। বলেছেন, এ জন্য তো আপনারাই দায়ী। যেহেতু আমি আওয়ামী লীগ করি, আমি প্রশ্ন করলে মানুষ তো পাল্টা প্রশ্ন করতে পারে। যিনি বিএনপি করেন তাকেও মানুষ একইভাবে প্রশ্ন করবে_ হরতাল তো আপনারা ডেকেছেন, আপনারা কাকে প্রশ্ন করেন। এ জন্য এ প্রশ্ন করার অধিকার সেই ধরনের মানুষের বেশি, যারা কোনো দল করেন না। যারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট তাদের সে অধিকার ততটা নেই।

সর্বশেষ অবস্থার কথা বলি। ১১ জুনের কথা। কি হলো তা সবাই আপনারা দেখেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবিতে বেগম জিয়া হালকা কর্মসূচি দিলেও ঈদের পরে কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। পরিস্থিতি স্পষ্ট জানান দেয় যে, সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে কোনো সমঝোতা হচ্ছে না। জামিন পেলেও বিরোধী দলের নেতারা ১১ তারিখ গণসমাবেশের আগে মুক্তি পাননি। তার মানে উভয় পক্ষের মধ্যে সংলাপ ইত্যাদি নিয়ে যে কথা বলা হয়েছিল তা হচ্ছে না। পরিস্থিতি সংঘাতের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

আমাকে ভুল বোঝার কোনো অবকাশ নেই। আমি রাজনৈতিক দল করার বিপক্ষে কোনো বক্তব্য দিচ্ছি না। আমি বরঞ্চ মনে করি, রাজনীতির বাইরে আমাদের সমাজের কোনো সমস্যার সমাধান শেষ পর্যন্ত হবে না। কিন্তু কোনো কোনো সময় থাকে মানুষ যখন রাজনীতির ওপর বিতৃষ্ণা হয়। এখন হলো তেমন একটি সময়। তার অর্থ আবারও সংঘর্ষ হবে, আবারও মানুষ মারা যাবে। আবার বাস পুড়বে। বাসের ড্রাইভার মারা যাবে, টেম্পোর ড্রাইভার মারা যাবে। কিংবা অফিসগামী কোনো নিরীহ মানুষ মারা যাবে। এ মৃত্যু উপত্যকার মধ্যে আমরা কেন বাস করব? কেন এ অবস্থার অবসান চাইব না? প্রশ্ন হলো, এ অবসান রাজনৈতিক দলগুলো কি চাইতে পারবে? রাজনৈতিক দল দুটির নেতাকর্মীরা এ বিষয়ে তাদের দলের প্রধান নেতা বা নেত্রীর সঙ্গে আলোচনা করতে পারবে? উভয় দলের মধ্যে লব্ধ প্রতিষ্ঠিত সর্বজনবিদিত অনেক নেতা আছেন। তাদের কি এ বিষয়ে শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলতে দেখেছেন?

একদিন আগে যিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে বলেছেন, একদিন পর তিনি তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন_ এটা কি আমরা দেখছি না? একই কথা কি বিএনপি সম্পর্কেও প্রযোজ্য নয়? এ কারণে নাগরিক সমাজের প্রশ্ন আসছে। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে আন্দোলন করতে পারছে না কিংবা এ সময় আন্দোলনে নামছে। সেহেতু নাগরিক সমাজকে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হচ্ছে। প্রাসঙ্গিকভাবে বাংলাদেশের জন্য আরেকটি কথা বলি। আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে মিলে এক সময় গণতান্ত্রিক আন্দোলন করতে নেমেছিল। সবারই মনে থাকার কথা, শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে সে পথ থেকে সরে আসতে হয়েছিল। কি কারণে? কারণ আওয়ামী লীগকে সমর্থনকারী মানুষ যারা গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি আস্থাশীল, তারা চাপ সৃষ্টি করেছিল। আমিও উপস্থিত ছিলাম সে ধরনের কয়েকটি সভায়। সেখানে অনেকে রীতিমতো তর্ক জুড়েছেন। তারা স্পষ্টভাবে বলেছেন, এ রাজনীতি আওয়ামী লীগের হতে পারে না। এটা কি একটি আন্দোলন নয়? সেই আন্দোলনে সিভিল সোসাইটি ভূমিকা রেখেছে। তারা বিএনপি বা কারোর হয়ে আন্দোলনে যায়নি।

গত লেখায় ১ জুন নাগরিক সমাবেশের যে কথা আমি বলেছিলাম সেখানে বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক উল হক বলেছেন, মাহমুদুর রহমান মান্না কি উদ্যোগ নিতে পারেন না, যাতে দুই নেত্রীর বসা সম্ভব হয়। এ দুই নেত্রী বসে আলাপ-আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করবেন। আমি সেদিন যে কথা বলেছিলাম সে কথা আজও বলছি। দুই নেত্রী কেন বসবেন? একটা হয়। নেলসন ম্যান্ডেলা যেমন বলেছেন, আমরা যখন পরস্পর বিবদমান, তর্কে লিপ্ত গ্রুপগুলো বসি তখন আমরা এ বিবেচনা করি না যে, আমি জিতলাম না সে জিতল। আমাদের বিবেচনা করতে হয় দেশ জিতল কিনা? আমাদের দুটি দলের মধ্যে এই বোধ কি আছে? দুই নেত্রী যদি বসেন তবে হিসাব করবেন আমি জিততে পারব তো? যতক্ষণ পর্যন্ত এ হিসাব না মিলবে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা বসার কথা ভাববেন না। যদি প্রচণ্ড কোনো আন্তর্জাতিক চাপ আসে, যার সামনে দুই বড় নেত্রী মাথানত করতে বাধ্য হন_ তবে তারা বসতে পারেন। আরেকটা হতে পারে। যেটি হলো নাগরিক সমাজের আন্দোলন। লাখো জনতা যদি বলে, হয় আপনারা সমস্যার সমাধান করবেন অথবা পথ ছেড়ে দেবেন, তাহলে হতে পারে। মানুষ এতদূর এগিয়ে এলে অনেক কিছুই সম্ভব।

এত প্রতিপত্তিশালী প্রধানমন্ত্রী বিমানবন্দর নির্মাণ করতে গিয়ে জমি দখলের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের আন্দোলনের সামনে কি নতিস্বীকার করেননি? আমাদের দুই নেত্রী যত বড়ই হোন কেউই জনতার চেয়ে বেশি শক্তিশালী নন। আমি উদাহরণ হিসেবে মাঝে মাঝে বলি, আন্না হাজারে ভারতবর্ষে যে অনশন করেছেন সেই অনশনে শক্তি দেখিয়েছেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করে। শেষ পর্যন্ত তিনি জিতেছেন। আমাদের দেশের টিআইবি নামের একটি সংগঠনের কথা এ প্রসঙ্গে বলা যায়। যদিও এটি একটি এনজিও, তবে তারা দুর্নীতি নিয়ে অনেক কাজ করছে। দুর্নীতি নিয়ে প্রচুর অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে দেশে এখনো কোনো নাগরিক আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। নাগরিক আন্দোলনের কথা কেন বলছি? কোনো দল যখনই দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে তখন বলা হবে, তোমরা অতীতে এটা করেছ। আর এখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলছ। তোমরাও তো দুর্নীতিবাজ। কিন্তু এ রকম ছাপ যাদের নেই_ ব্যারিস্টার রফিক উল হক যেমন বলেছেন, যাদের গায়ে গন্ধ নেই তারা যখন মাঠে নামবেন, পথে নামবেন তখন নিশ্চয়ই তার পেছনে জনগণ আসবে।

এই যে নাগরিক আন্দোলনের কথা বলা হলো, তারা কিন্তু নিজেদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা দাবি করছে না। স্পষ্টতই তারা আওয়ামী লীগবিরোধী নয়, বিএনপিবিরোধীও নয়। তারা যেমন উভয়ের বিরুদ্ধে আবার উভয়ের পক্ষে। তারা চায় উভয় দল যতদূর সম্ভব পরিশীলিত হয়ে গণতন্ত্রসম্মত হয়ে জনকল্যাণধর্মী হয়ে মানুষের সামনে আসুক। আমরা সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য যেখানে দুটি শক্ত-পোক্ত-অভিজ্ঞ-সমৃদ্ধ দল দরকার, সেখানে অযথা তাদের নিন্দা করে ছোট করে দেশের লাভ হতে পারে না। আমি আবারও বলছি, আওয়ামী লীগ বা বিএনপিকে খাটো করবে কোনো আন্দোলনের এমন লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। তবে আমরা চাই বা না চাই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা তাদের আচরণ ও উচ্চারণে নিজেরা ছোট হচ্ছেন এবং দলকে ছোট করছেন। এই ছোট হতে হতে এমন ছোট হন যে, তারা জনগণের হাঁটুর নিচে চলে যান। সে বোধ যেন তাদের মধ্যে থাকে। তখন সংবিধানবহিভর্ূত শক্তির ক্ষমতা দখলের প্রশ্ন ওঠবে। যা ইতোমধ্যে উঠছে এবং সরকারি দলই সেটা বেশি করে তুলছে। কেন? এত যে বড় গলায় হৈচৈ করে পঞ্চদশ সংশোধনী করা হলো এবং সেখানে বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে বিশেষ ধারা-উপধারা যুক্ত করা হলো, এর পরও এ প্রশ্ন কেন আসবে? তার মানে কি এসব ধারা-উপধারা দিয়ে সামরিক শাসন রোধ করা যাবে না? এগুলোর কি কোনো মূল্য নেই? তাহলে এগুলো আনলেন কেন?

আমেরিকা ইউরোপ এমনকি ভারতে কখনো সামরিক আইনের প্রশ্ন আসে না কেন? কারণ সেখানে এটি আসার মতো কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক ভিত্তি নেই। আমাদের এখানে এর রাজনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তি তৈরি হয়। আমরাই তা তৈরি করি। আমি মনে করি, সামরিক আইন বন্ধ করার বিষয়টি মূলত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সাফল্যের ওপর নির্ভরশীল। দুটি দলের পারস্পরিক আচরণ, পরস্পরের প্রতি সহনশীলতা, সহমর্মিতা এবং তার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিকতা গড়ে তোলার ওপর নির্ভরশীল। আমি বলতে চাই, সিভিল সোসাইটি বা নাগরিক আন্দোলন_ এই গণতান্ত্রিকবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ গড়ে তোলার কাজে সহায়ক। তারা এ ক্ষেত্রে কোনো আপস করবে না। রাজনৈতিক দলের নেতা তার চেয়ে বড় নেতার সঙ্গে আপস করে। এক দল আরেক দল নেতার কাছে স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আপস করে। কিন্তু সিভিল সোসাইটির এ আন্দোলন আপস করবে না। তারা আওয়ামী লীগের জন্যও আপস করবে না, বিএনপির জন্যও আপস করবে না। তারা মূলত জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত থাকবে। সিভিল সোসাইটি সব সময় গণতন্ত্রের সহায়ক শক্তি। গণতন্ত্র বিনির্মাণে রত রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়ক শক্তি। তাদের সে রকম করে বোঝাই উচিত। এ শক্তি কি কখনো রাজনৈতিক দল হতে পারে? স্বাভাবিকভাবে না। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে এ রকমভাবে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবিভর্ূত হয়েছে এর প্রমাণ অনেক আছে। জার্মানির গ্রিন মুভমেন্টের কথা আমরা জানি। এটি নাগরিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েই গড়ে উঠেছে। পোল্যান্ডে লেচ ওয়ালেসার সলিডারিটি মুভমেন্ট এরকম আরেকটি উদাহরণ হতে পারে। নাগরিক আন্দোলন গণতন্ত্র প্রশিক্ষণের একটি কেন্দ্র হতে পারে। এখান থেকে অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব গড় উঠতে পারে। তবে নাগরিক আন্দোলন নিজে থেকে নিশ্চয়ই কোনো রাজনৈতিক দল নয়। অতএব, রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের প্রতিপক্ষ মনে করা উচিত নয়।

লেখক : রাজনীতিক

ই-মেইল : mrmanna51@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন