মঙ্গলবার, ৩ জুলাই, ২০১২

তৃতীয় শক্তি প্রসঙ্গ

মাহমুদুর রহমান মান্না


২২ তারিখে প্রেস কনফারেন্স করার পর থেকে একটি আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। অনেক জবাব পাচ্ছি, মতামত, সমালোচনা, আত্দসমালোচনা ইত্যাদি। একটি উদ্ধৃতি বা একজনের একটি মন্তব্য দিয়ে শুরু করি। বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত লেখক মন্তব্য করেছেন মাহমুদুর রহমান মান্না যদি সত্যিই একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন তাহলে বিএনপির হয়তো আখেরে লাভ হবে। তাদের জোটের সদস্য সংখ্যা বাড়বে। ১৮ দলের জোটের বদলে ১৯ দলীয় জোট তৈরি হবে। শূন্য+শূন্য+শূন্য = শূন্য। মান্নার দল এই শূন্যতার রাজনীতিতে যুক্ত হবে।

হাসব নাকি কাঁদব তাই ভাবছি। অনেকে আছেন_যারা নিজেদের সবজান্তা মনে করেন। আর এ কারণে সবকিছু না হোক মূল বিষয়টুকু, নির্যাসটুকু ভালো করে জানার চেষ্টাও করেন না। ২২ তারিখে যে সংবাদ সম্মেলন আমি করেছি সেখানে নাগরিক ঐক্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। ১ জুন ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনে আমরা একটি সমাবেশ করেছিলাম। প্রধানত ঢাকা সিটি করপোরেশনের উত্তরে যারা আমার সঙ্গে কাজ করেছিলেন তাদের ব্যাপক অংশ সেখানে যোগ দিয়েছিলেন। ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন কানায় কানায় ভর্তি ছিল। তাদের সবার একটি বক্তব্য ছিল, ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন আপাতত বন্ধ করা হয়েছে ঠিক, কিন্তু সে নির্বাচন তো দিতে হবে একদিন না একদিন, যতদিন পরই হোক। আমরা একটি চিন্তার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম, কাজকর্ম শুরু করেছিলাম। আমরা মনে করেছিলাম, নিছক দলবাজি নয়, একটি সত্যনিষ্ঠ দিক-নির্দেশনামূলক রাজনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলের ভিত্তিতে নয়, সৎ ও যোগ্যতার ভিত্তিতে ভোট দিব।

গত ৪০-৪২ বছরে বাংলাদেশের অগ্রগতি, অবস্থান, অবস্থা_ রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবে খুব সন্তোষজনক নয়। এমনিতে এশিয়ান টাইগার বলা হয় যেসব দেশকে তারা তো এগিয়ে গেছেই, এমনকি ভুটান, নেপালও অনেক ক্ষেত্রে আমাদের চেয়ে এগিয়ে। এটাই মানুষের কাছে বেশি উদ্বেগের কারণ হয়েছে। রাজনীতি সম্পর্কে এ জন্যই মানুষের একটা বিতৃষ্ণ ভাব জন্মেছে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিসহ সামগ্রিকভাবে আমাদের রাজনীতিতে একটি সংস্কৃতি চালু হয়ে গেছে_ সেটা হলো তোষামোদের সংস্কৃতি। নেতা যখন কথা বলছেন তখন দলের পক্ষে বলছেন, নেত্রীর পক্ষে বলছেন, কখনো আত্দসমালোচনামূলক কিছু বলছেন না। ওয়ান-ইলেভেনের পর মানুষ আশা করেছিল, দুটি বড় দলের মধ্যে বোধোদয় হবে। যে অমীমাংসেয় দ্বন্দ্বের কারণে ওয়ান-ইলেভেনের মতো ঘটনা ঘটেছে, সে রকম যেন ভবিষ্যতে না হয় এবং গণতন্ত্রের পথ যাতে তুলনামূলকভাবে মসৃণ হয় সে রকম সংস্কৃতি তারা চালু করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে গত সাড়ে তিন বছরের ইতিহাসে দেখা গেল এ সম্পর্ক দিন দিন আরও খারাপ হয়েছে এবং রাজনীতি একটি সাংঘর্ষিক দিকে চলে গেছে। খালেদা জিয়া সর্বশেষ সমাবেশে বলেছেন, যেহেতু সামনে রোজা তাই বড় ধরনের কোনো কর্মসূচি দেবেন না। রোজার পরে কর্মসূচি দেবেন এবং তা হবে সরকার পতনের কর্মসূচি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পাল্টা হুমকি দিয়ে বলেছে, এ ধরনের আন্দোলনের হুমকিতে তারা ভীত নয়, তারা রাজপথে দেখে নেবে। বিষয়টি তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? ইতোমধ্যে এ দুই দলের রাজনীতির কারণে 'এ' লেভেলের পরীক্ষার্থীদের রাত ১২টার সময় পরীক্ষা দিতে হয়েছে। অন্যান্য দু'একটি পরীক্ষাও ছুটির দিনে দিতে হয়েছে। হরতাল ডাকা হয়নি। কিন্তু সরকারি দলের আচরণে সারা দেশে হরতালের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিনা নোটিশে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা ফেরার সময় ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় দীর্ঘক্ষণ আটকে থেকেছে। সমাজ, ব্যক্তি, পারিবারিক জীবনে যেখানে রাজনৈতিক দলের শান্তি নিশ্চিত করার কথা, সেখানে তাদের আচরণে নাগরিকদের কষ্ট আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা খুবই দুঃখজনক এবং বলা যায়, দেশের জনগণ এ দুটি রাজনৈতিক দলের কাছে এখন জিম্মি হয়ে আছে। এরা জনগণের কথা শুনছে না বরং জনগণ তাদের কথা শুনতে বাধ্য হচ্ছে। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ওই সমাবেশে একটি বক্তব্য রেখেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে যেখানে যেখানে গেছেন, সেখানেই দেখেছেন সাধারণভাবে, মানুষ দুই নেত্রীর ওপর বিরক্ত। দুই দলের ওপর সন্তুষ্ট নয়। তিনি বলেছিলেন, মাহমুদুর রহমান মান্না যদি এ দুই দলের সংঘর্ষিক পরিস্থিতি বন্ধ করতে উদ্যোগ নিতে পারেন, তাদের বসাতে পারেন, কাজ করতে পারেন তাহলে সেটা ভালো হবে। আমি বলেছিলাম, তাদের দুজনকে বসাতে পারব সেটা বলা যাবে না। কারণ তারা দুজন যথেষ্ট পরিমাণে পরিপক্ব হয়েছেন রাজনৈতিকভাবে। রাজনীতি তারা ভালো বোঝেন। নিজেদের ভালো বোঝেন, দেশের ও দশের ভালো বোঝেন নিশ্চয়ই। কোন সময় কোন রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে সেটা তারা তাদের নিজের বিবেচনায় তাদের দলীয় বিবেচনায় গ্রহণ করবেন। আমার কথায় নয়। এটা কোনো বাচ্চা মেয়েকে বোঝানোর বিষয় নয়। তবে আমি এটা মনে করি, দেশে যেহেতু সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চা হচ্ছে এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য দুটি দলের মুখ্য ভূমিকা থাকা দরকার সেই হিসেবে বাংলাদেশে এটি দ্বিদলীয় পদ্ধতিতে গড়ে উঠেছে। দুই দলের একটি বিএনপি আরেকটি আওয়ামী লীগ। এ দুই দলের মধ্যে যত সুসম্পর্ক থাকবে, যত বেশি তারা সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চা করবেন দলের অভ্যন্তরে দলীয় গণতন্ত্র চর্চা করবেন তাতে দেশের কল্যাণ হবে। এটি ঠিক আমরা দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চা করতে পারছি না এবং সামগ্রিকভাবে দুই দলের রাজনীতি পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার সমঝোতার পরিবর্তে দিনের পর দিন সাংঘর্ষিক হয়ে যাচ্ছে। পরিণতি হচ্ছে দল বা দেশ তার কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন পাচ্ছে না এবং এককথায় বলা যেতে পারে, আমরা যতখানি এগুবার কথা ছিল তার চেয়ে বেশি পিছিয়ে যাচ্ছি।

সাংবাদিকদের অনেকে প্রশ্ন করেছিলেন, নবগঠিত এই সংগঠন, নাগরিক ঐক্য কি একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠবে? আমি প্রশ্নের জবাবে তাদের বলেছি, এটি প্রধানত নাগরিকদের একটি সংগঠন। ২২ তারিখে আমরা যখন কমিটি গঠন করেছিলাম তখন আমাদের সঙ্গে ঢাকা দক্ষিণের মেয়রপ্রার্থী ড. তুহিন মালিক উপস্থিত ছিলেন। এ রকম করে তিনিসহ দক্ষিণের আরও অনেকে যারা তার সঙ্গে রাজনীতিতে বা নির্বাচনে ছিলেন এমনকি বিগত দিনে যারা সমাজকর্মী ছিলেন তারা এসেছিলেন। শুধু উত্তরই নয়, উত্তর-দক্ষিণ মিলে একটি বিরাট কমিটি গঠন করা হয়েছিল। আমি জবাবে বলেছিলাম, আমরা একটি নাগরিক সংগঠন গঠন করছি, যারা অচলায়তন রাজনীতির ওপর আঘাত হানতে পারবে। কোনো সন্দেহ নেই নাগরিক ঐক্যের সামনে বড় বিবেচনার বিষয় গণতান্ত্রিক এবং মৌলিক অধিকার। এ দুটি শব্দ আমরা যখন বলি তার সঙ্গে রাজনীতি অঙ্গাঙ্গীভাবে এসে পড়ে। কিন্তু যে কোনো মানুষ যখন মৌলিক অধিকারের পক্ষে কথা বলে তার মানে এই নয় যে, সে একটি পার্টি করে। সে যখন গণতন্ত্রের কথা বলে তার মানে সে পার্টি করে এ রকম কোনো বিষয় নেই। অতএব আমরা যে যাত্রা করছি, এটি কোনো দল করার বিবেচনা থেকে করছি না।

একজন বন্ধু বলেছেন, মাহমুদুর রহমান মান্না একটি নতুন দল গঠনের প্রস্তুতিপর্ব হিসেবে সমাবেশ ঘটিয়েছেন এবং নতুন দল গঠিত হলে প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক এবং প্রবীণ সাংবাদিক এ বি এম মূসা দলটির উপদেষ্টা হতে পারেন। কতখানি ভ্রান্ত ধারণা থেকে এই কথাগুলো বলা হলো তা সহজেই বোধগম্য। কারণ ব্যারিস্টার রফিক-উল হক সবসময় এ কথা বলছেন, তিনি কখনো কোনো রাজনৈতিক দল করবেন না। তার এ রকম কোনো ভাবনা নেই। আর যিনি বা যারা এ কথাগুলো বলছেন তার অবগতির জন্য বলছি, এ বি এম মূসাকে ব্যক্তিগতভাবে সমাবেশ শেষে সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এটি কি কোনো রাজনৈতিক দল হচ্ছে? এটি কি ভবিষ্যতে কোনো নির্বাচন করবে? তখন তিনি বলেছিলেন, যতদূর আমাকে বলা হয়েছে, আমি ততদূর জানি। এর বেশি আমি বলতে পারব না। কারণ আমি এর গঠনের ভেতরে এ রকমভাবে ছিলাম না। আর একটি রাজনৈতিক দল গঠনের উপদেষ্টা হিসেবে আমি এখানে আসিনি। বিষয়টি খুবই স্পষ্ট যে, তারা কেউ একটি রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্দেশ্যে আমাদের সমাবেশে আসেননি। যারা এ রকম বলছেন তারা মূলত নাগরিক আন্দোলন সম্পর্কে বিভ্রান্তিতে ভুগছেন। তাদের কোনো কোনো বন্ধু হয়তো দেশে-বিদেশে আছেন, তারা হয়তো বলছেন এটি কোনো রাজনৈতিক দল হিসেবে দাঁড়াতে পারে। আমি এ কথা অস্বীকার করব না, এই কারণে যে, আমি এটি খেয়াল করছি এবং যারা এ কথাগুলো বলছেন তাদের বলছি, এটি একটি বাস্তবতা। ব্যারিস্টার রফিক ঠিক কথা বলেছেন। দুটি দল এবং দলের নেতৃত্বের কাছে আমরা প্রায় জিম্মি হয়ে পড়েছি। মানুষ হয়তো অনেক কিছু পছন্দ করতে পারছে না। কিন্তু মানা ছাড়া কোনো উপায় নেই। হয়তো মানুষ ভেতরে ভেতরে এ রকম আশঙ্কায় আছে যে, এ দুই দল যে রকম রাজনীতি করছে তার চেয়ে ভালো দল যদি দাঁড়ায় বা ভালো কোনো শক্তি দাঁড়ায় তবে তার পক্ষে আমরা থাকব। তার প্রমাণ মানুষ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দিয়েছে, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে দিয়েছে এবং আমি দাবি করছি যদি ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন হতো তাহলে হয়তো এখানে মানুষ এ ধরনের একটি রায় দিতে পারত। প্রশ্ন হচ্ছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সময় মানুষ যখন এ রকম বলছে, সে ধরনের বিষয় আগামী জাতীয় নির্বাচনে হতে পারে কি? এটি দেখার বিষয়। জাতীয় নির্বাচনে এমন হয় যে, মার্কা থাকে দুটি বড় দল থেকে। তার বাইরে তো আর কেউ নেই। অতএব এ দুটির মধ্যে বিবেচনাও থাকে। 'এ বি'র বাইরে যদি সে রকম কোনো শক্তি আসতে পারে, তাহলে কি মানুষ অন্য কোনো কিছু ভাববে? মানুষের ভাবনার ওপর কেউ কি বাজি রাখতে পারবেন? মানুষের ভাবনা কি কেউ জোর করে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে পারবেন? মানুষ যদি এতকিছুর পর সত্যিই এই দুই দলের মধ্যে পরিবর্তন দেখতে চায়, তাহলে তাই হবে। আমি খুব স্পষ্ট করে বলছি নাগরিক আন্দোলন এবং নাগরিক ঐক্যের প্রথম বিবেচনা হচ্ছে এই দুটি দল যেন অভ্যন্তরীণভাবে আরও বেশি গণতান্ত্রিক হয়, আরও বেশি পরস্পরের প্রতি সহনশীল হয়। আরও বেশি শ্রদ্ধাশীল হয়। ভিন্নমত ও পরমত সহ্য করার মতো মানসিকতা যেন তাদের থাকে সেদিকে যেন তারা বেশি দৃষ্টি দেওয়ার চেষ্টা করেন। যদি তারা ভালো হয়ে যান, আরও উন্নত হন, মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হন, তবে মাহমুদুর রহমান মান্না বা ব্যারিস্টার রফিক কিংবা এ বি এম মূসা চাইলেই কি আরেকটি দল বা শক্তি গড়ে তুলতে পারবেন? গায়ের জোরে রাজনীতি করা যায় না। কিন্তু যদি দুই দল ব্যর্থ হয় তাহলে সবসময় অন্য একটি কিছু হওয়ার বস্তুগত অবস্থান তৈরি হয়ে যে থাকে এই কথা যে কোনো বিজ্ঞ মানুষের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বন্ধুদের কেউ কেউ (সবাইকে বন্ধু বলা হয়তো আমার জন্য বেয়াদবির শামিল হবে) গুরুজন অথবা মুরবি্বদের কেউ কেউ আমাকে এ রকম একটি উপদেশ দেওয়ার চেষ্টা করছেন যে আওয়ামী লীগকে শোধরাতে হলে দলের ভেতরে বসেই কঠোর প্রতিজ্ঞা নিয়ে দক্ষিণপন্থি সুবিধাবাদী কায়েমি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। সুন্দর প্রস্তাব। কিন্তু এটা কি সম্ভব? কতখানি সম্ভব? (আগামী বুধবারের সংখ্যায় এর ওপর লিখব)।

লেখক : রাজনীতিক

ই-মেইল : mrmanna51@yahoo.com

বুধবার, ২৭ জুন, ২০১২

বিএনপির আন্দোলন-২

মাহমুদুর রহমান মান্না


গত সংখ্যায় বলেছিলাম_ আগামীতে বিএনপির আন্দোলন, আন্দোলনের কৌশল, ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা ইত্যাদি বিষয়ে লিখব। আজ এমন একটি দিনে লিখতে বসছি যেদিন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। গত সংখ্যায় লেখা প্রকাশ হওয়ার পর একজন ভদ্রলোক আমাকে ফোন করেছিলেন। যতদূর মনে পড়ে তার নাম মাসুদ। তিনি আমার চেয়ে দু'এক বছরের সিনিয়র হবেন। ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি মোটামুটিভাবে সক্রিয় ছিলেন। তিনি আমার একটি ভুল সংশোধন করেছেন বা তিনি যেটাকে ভুল মনে করেছেন সে সম্পর্কে বলেছেন। আমি বলেছিলাম আইয়ুব খানের যে পতন হলো ওই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানে তেমন বড় আন্দোলন হয়নি, যার কারণে তাকে পদত্যাগ করতে হবে। প্রধানত এখানকার আন্দোলনের কারণেই তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। তিনি ফোনে আমাকে বললেন, আপনার এ লেখা যেহেতু অনেকে পড়ে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম, তাদের মধ্যে একটি ভুল তথ্য থেকে যেতে পারে। কারণ ওই সময় পশ্চিম পাকিস্তানেও ব্যাপক আন্দোলন হয়েছিল। তিনি বললেন, আমার মনে আছে, তখন আমি সেই আন্দোলনের মধ্যে ছিলাম। আর সারা পৃথিবীতেই তখন যুব আন্দোলন, যুব বিদ্রোহের একটি সময় চলেছে। ফ্রান্সে দ্যগলের মতো লৌহমানব যুব সমাজের আন্দোলনের মুখে প্রথম পালিয়ে গিয়েছিলেন। পরে অবশ্য ফিরে এসে আবার নির্বাচনে জিতেছিলেন। সেটি এক বিস্ময়কর ঘটনা। মাসুদ বললেন, আমরা সবসময় নিজেদের কাজ নিয়ে গর্ব এবং অহঙ্কার করি। তার জন্য হয়তো অন্যের বিষয়ে ভালো করে খোঁজও নেই না। কিন্তু সত্যি কথা হলো, পশ্চিম পাকিস্তানে তখন যে ব্যাপক আন্দোলন হয়েছিল এবং প্রধানত সে আন্দোলনের কারণে পাঞ্জাবি শাসকচক্রের ভিত নড়ে গিয়েছিল। তাদের নিজেদের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়েছে সে কারণে শেষ পর্যন্ত আইয়ুব খানকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। পাঠক জ্ঞাতার্থে আমি এ বিষয়টি এখানে লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজন মনে করলাম।

ক্ষমতার বিষয়টিকে অনেক দিক দিয়ে দেখা দরকার। বক্তৃতায় আমরা বলি '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এতবড় প্রচণ্ড প্রতাপশালী আইয়ুব সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছে, কিন্তু বুঝতে হবে ক্ষমতা একটি সর্ব ব্যাপক জিনিস। ক্ষমতার পরিবর্তন একটি বিরাট আলোড়ন-আন্দোলনের ফলে হয়। এর বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ অনেক কারণ থাকে। সেগুলো পরিপূর্ণ ও পরিপক্ব না হলে ক্ষমতায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসে না। সেদিক থেকে মাসুদ সাহেব আমাকে যে সাহায্য করেছেন তার জন্য তাকে অনেক ধন্যবাদ। আর সে বিবেচনা সামনে রেখে আমি এখন আমার বর্তমান লেখার প্রসঙ্গে কিছু কথা লিখব।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বড় ধরনের গণআন্দোলনের উদাহরণ যদি দেওয়া যায় তাহলে সেটি এরশাদের বিরুদ্ধে। সামরিক ফরমান জারি করে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন। তখন দেশে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো বড় দুটি দল ছিল। তারপরও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নয় বছর ক্ষমতায় ছিলেন। নয় বছর পর তিনি যে চলে গেলেন_ আমরা সবাই এরকম করে বলি তিনি একটি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গেছেন। কিন্তু আমি এ কথা বলব, যারা '৬৯ দেখেছেন তারা মানবেন বা আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, এরশাদ আমলের ছাত্র আন্দোলন বা গণঅভ্যুত্থান '৬৯-এর মতো ছিল না। এ আন্দোলন দীর্ঘদিন ধরে করতে করতে শেষ পর্যন্ত সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে যুক্ত করতে গিয়ে করা হয়েছিল জনতার মঞ্চ। সচিবালয় থেকে সবাই এসে যোগ দিয়েছিলেন এবং এক অর্থে প্রশাসন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল। প্রশাসনকে যদি এরকম ভেঙে তছনছ না করা যেত, তাহলে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ পদত্যাগ করতেন কিনা এ কথা বলা এখন মুশকিল। কারণ সময় গেলে মানুষের কথার বদল হয়। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয়। নিশ্চয় এমনকি খোদ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ওই সময় যেরকম করে অবস্থা দেখতেন এখন সে রকম দেখেন না। তার বক্তব্য শোনলেও হয়তো তখনকার বাস্তব পরিস্থিতির চিত্র এখন পাওয়া যাবে না। কিন্তু এটা সত্যি রাজপথে লাখ লাখ মানুষের মিছিল উত্তাল গণজাগরণে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পদত্যাগ হয়নি। কারণ এরপরে যে নির্বাচন হয়েছিল সে নির্বাচনে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে বহুভাবে আইনের বিধানে আটকে রাখলেও জাতীয় পার্টি আশাতীত সাফল্য অর্জন করেছিল। এটা সম্ভব হয়েছিল কিভাবে? আমি বলতে চাচ্ছি, এ ধরনের গণঅভ্যুত্থানের কথা আমরা মাঝে মাঝে বক্তৃতায় বলি। সেগুলোর অর্থ সবই এই অর্থে পরিচ্ছন্ন নয়। এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলি_ আমাদের এ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে নেতাদের বক্তৃতায় যতবেশি আবেগ থাকে ততবেশি যুক্তি ও বিশ্লেষণ থাকে না। অতএব শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানুষকে উদ্দীপ্ত করা এবং সেখানে ক্ষমতা কিংবা রাজনীতির যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক থাকে সেটিতে পরিবর্তন ঘটে যায়নি। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও শেষ পর্যন্ত সিভিল প্রশাসন ও সামরিক প্রশাসনের মধ্যে বাধাগ্রস্ত হওয়ার পর পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। পাঠক, এগুলো হলো ভূমিকা। ভূমিকায়ই অনেক কথা বলার চেষ্টা করছি আমি। আমি বলছি বিএনপি খুব একটি পরিপক্ব রাজনৈতিক দল তা হয়তো বলা যাবে না। অনেকে যে রকম বলেন বিএনপি কোনো রাজনৈতিক দলই নয়, ওটা ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছে, সামরিক বাহিনীর লোকদের আবার বুদ্ধি কোথায়, তাদের বুদ্ধিতো হাঁটুতে থাকে। এ ধরনের কথাবার্তার কোনো মানেই নেই। কোনো কোনো সামরিক নায়ক দীর্ঘদিন দেশ শাসন করেছেন বা দেশ চালিয়েছেন। জনপ্রিয় হিরোর মতো মারা গেছেন। অনেকের কথা বলতে পারি। মিসরে কিংবা লিবিয়ায় আমাদের সময়কার এরকম কিছু বড় বড় ঘটনা ঘটতে দেখেছি। আমি এই প্রসঙ্গটি এ জন্য আনলাম যে, বিএনপি ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের ঘোষণা করেছে ধীরে ধীরে, আর এ কারণে আজ প্রায় চার দশকের কাছাকাছি সময় পার করার পরে বিএনপি রাজনীতিতে একেবারে অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, এগুলো যে কোনো বিবেচনায়ই আনা যাবে না এরকম ভাবার দরকার নেই। আমি আমার গত লেখায় যে রকম বলেছিলাম এখন সেই লেখারই প্রতিধ্বনি করছি। বিএনপি খুব হিসাব করছে। তারা মনে করছে নির্বাচনে জিতবে। যদি সেটি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়। তাতে আওয়ামী লীগ জিততে পারবে না। আমার কথার প্রমাণ দিয়েছেন সদ্য কারামুক্ত বিএপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি আলোচনায় বলেছেন, বিএনপি যে কোনোভাবেই কোনো তৃতীয় শক্তির আবির্ভাবের বিরোধিতা করছে। তারা তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব দেখতে চান না। তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ব্যাপারটা যদি রাজনৈতিকভাবে হয়, তিনি তার বিরুদ্ধে কথা বলছেন না। কিন্তু অরাজনৈতিক ও অসাংবিধানিকভাবে যদি কোনো তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব হয় তাহলে বিএনপি সেটিকে সর্বশক্তি দিয়ে ঠেকাবে। এই একটি মজার ব্যাপার। পাঠকদের অনেকের মনে থাকতে পারে, যখন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এসেছিলেন তখনো আমাদের দেশে এই বড় দুটি রাজনৈতিক দল ছিল। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। এই দুই দল যদি সজাগ, সচেতন ও রাজপথে থাকত তাহলে কি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় আসতে পারতেন? বিশ্লেষকরা বলেন, প্রধানত এ দুটি রাজনৈতিক দলের পারস্পরিক দ্বন্দ্বের মধ্যদিয়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বেরিয়ে এসেছেন।

আর এ প্রসঙ্গে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে দোষারোপ করে যে, তারাই তখন সামরিক শাসন টেনে এনেছিলেন। তাদের দুর্বলতায় বা তাদের আশকারায় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতায় আসতে পেরেছিলেন। ঠিক এরকমভাবে আমি বলি_ যখন জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে সামরিক বাহিনীর সমর্থন নিয়ে একটি সরকার তত্ত্বাবধায়কের নামে তিন মাসের জায়গায় দুই বছর ক্ষমতা দখল করেছে, তখনো কিন্তু একইরকম অভিযোগ করা হয়েছে। বেশি করে এ ব্যাপারে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ আসছে, কারণ আওয়ামী লীগের নেতারা সেই সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরও একজন আরেকজনকে অভিযোগ করার ব্যাপারে ছাড়ছেন না যে, সামরিক সরকার আসার সুযোগ তাদের কারণে হয়েছে।

এখনো একই বিষয়ের প্রতিধ্বনি আমি দেখতে পাচ্ছি। বেশ কিছুদিন খোদ প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের মন্ত্রীরা, আওয়ামী লীগের নেতারা এই কথা বলছেন যে, সামরিক বাহিনীকে আশকারা দিচ্ছে বিএনপি। তারা তাদের উস্কে দিচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। ঠিক বর্তমান পরিস্থিতিতে আবার উল্টো দিকে যেতে শুরু করেছে বিএনপি। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপির পক্ষ থেকে এ কথা চালু করার চেষ্টা করছেন যে, আওয়ামী লীগ জনসমর্থন হারিয়ে ফেলেছে। যদি নির্বাচন দেওয়া হয় তাহলে তারা জিততে পারবে না। এ জন্য তারা তৃতীয় কোনো শক্তির হাতে, অরাজনৈতিক কোনো শক্তির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে যেতে চায়। পঞ্চদশ সংশোধনী খুব দৃঢ়তার সঙ্গে গ্রহণ করে বলা হলো কোনোভাবেই যেন এ দেশে আর কোনো সামরিক শাসন না আসতে পারে তার জন্য এ সংশোধনী। তখন মনে হয়েছে, অন্তত আওয়ামী লীগ ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছে যে, বিএনপি সম্ভবত আওয়ামী লীগের বদলে সামরিক সরকারকে চাইছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক তখন এ রকম মত প্রকাশ করেছেন যে, এই দুই নেত্রী পরস্পর পরস্পরের ওপর এতই বিতৃষ্ণ যে, যদি নিজে থাকতে না পারেন তাহলে অন্য কাউকে দিয়ে যাবেন তবু একে থাকতে দেবেন না। অনেকটা জেদের ভাত কুকুরকে খাইয়ে দেওয়ার মতো। মানুষ কি বুঝছে, কি বুঝবে তারা তার জবাব দেবে; কিন্তু মূল কথা দুটি দলের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই চলছে।

বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে কিংবা আমাদের দেশের ক্ষমতার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক শক্তির একটা প্রভাব আছে এ কথা আমরা সবাই বলি। এ কথার মানে কি? আন্তর্জাতিক শক্তি, বৃহৎ শক্তি, প্রতিবেশী শক্তি তাদের ইচ্ছার দাস হিসেবে কাউকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে? এ রকম আসলে হয় না। দ্বন্দ্বতত্ত্ব যে রকম বলে বস্তুর বিকাশ হয় বস্তুর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে, ঠিক সেরকম করে দেশের মধ্যেই যদি সেই দুর্বলতা না থাকে তাহলে বাইরের কোনো শক্তি কিছু করতে পারে না। আমাদের দেশের জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, যতটা বিস্তার লাভ করেছিল সেটা দমন করার প্রচেষ্টায় আওয়ামী লীগ বেশ খানিকটা এগিয়ে আছে। সবাই বলে জঙ্গিবাদ দমনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ বেশ কিছু পয়েন্ট অর্জন করেছে এবং বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তারা জঙ্গিবাদকে মদদ দিয়েছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই বাংলাভাইয়ের উত্থান, বিভিন্ন জায়গায় বোমা হামলা এসব ঘটনা থেকে তারা বহির্বিশ্বকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে, বিএনপি এ ব্যাপারে নিশ্চুপ। আর তখন ক্ষমতায় ছিল যে বিএনপি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে তারা এ ব্যাপারে অনেকটা চোখ-কান বন্ধ রেখেছিলেন। বলেছিলেন এসব বাংলা ভাই কিংবা জঙ্গিবাদ মিডিয়ার সৃষ্টি। বাস্তবে এদের কোনো অস্তিত্ব নেই। এই একটি কারণে বিএনপি এখনো বহির্বিশ্বের সমর্থনের জায়গায় প্রচণ্ড রকম দুর্বল রয়েছে। বিএনপির নেতৃত্বের মধ্যে এক বিরাট আপেক্ষিক শূন্যতা বিরাজ করছে। আপেক্ষিক এ কারণেই বললাম, বেগম জিয়ার যথেষ্টই বয়স হয়েছে। তিনি এরই মধ্যে বিভিন্ন জনসভায় বলেছেন, তিনি নতুন নেতৃত্বের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে চান। সবাই ভেবেছে নতুন নেতৃত্ব বলতে তিনি তার পুত্রকে বোঝাতে চাইছেন। তার পুত্ররা বিগত জোট সরকার আমলে এমন এমন কাজ করেছেন, যেগুলো নিয়ে বিরোধী দল প্রচার-প্রচারণায় নেমেছিল, যা মানুষ বিশ্বাস করেছিল। যার কারণে বিএনপি নির্বাচনে পরাজয় বরণ করেছিল। এমনও প্রচার হয়েছিল যে, বেগম জিয়ার বড় ছেলে যিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তিনি তখন জঙ্গিবাদিদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছিলেন। আমি কোনো বিতর্কের মধ্যে যাচ্ছি না সত্যি কিংবা মিথ্যা নিয়ে। রাজনীতি এমন একটি জিনিস, আমি মাঝে মাঝে বলি, সত্য মিথ্যার বিচার পরে হয়। মানুষ কোনটাকে সত্য বলে জেনেছে তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। এটি বিএনপির জন্য একটি বিরাট মাইনাস পয়েন্ট। বিএনপি চাইলে আন্দোলন করে ক্ষমতায় চলে যাবে এরকম নয়। আমার কাছে কিছু কিছু ঘটনা এরকম মনে হয়েছে যে, বিএনপির পক্ষ থেকে এখন আন্তর্জাতিক এই লবিকে পক্ষে টানার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমি জানি না, মার্কিন পররাষ্ট্র সেক্রেটারি হিলারি ক্লিনটন যখন এলেন তখন তিনি যেরকম করে বেগম জিয়ার বাসায় গেলেন, দেখা করলেন, কথা বললেন, পাটি সাপটা গেলেন, সবমিলে সেই দৃষ্টির আদৌ কোনো পরিবর্তন ঘটছে কিনা। এটা কি তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের বার্তা দেয় নাকি সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ প্রয়োগের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা এখনো জানা যায়নি। আর এদিকে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত যারা আমাদের এখানকার রাজনীতিতে বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন রকম প্রভাব ফেলে সেই জায়গাতেও বিএনপি নিশ্চয় কিছু একটা করার চেষ্টা করছে, যাতে তারা তাদের প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন না থাকে। কিন্তু সে দিকে কতখানি সফলতা তারা অর্জন করেছে, সেটা বলতে পারব না। বিএনপি আন্তর্জাতিক এই সম্পর্কের ব্যাপারে এতদিন উদাসীন ছিল তার কারণ হচ্ছে, এখানে তাদের কোনো যোগ্য নেতৃত্ব ছিল না বা যারা ছিল অতীতে তাদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। শোনা যায়, বেগম জিয়া এ ব্যাপারে নিজের থেকে আগ্রহ নিয়ে এসব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছেন। একই ঘটনা হয়তো আওয়ামী লীগ সম্পর্কে বলা যায়। বলা যায়, উভয় দল আগামীতে আন্দোলনের নামে যাই করুক না কেন, ক্ষমতার পালা বদলের জন্য যাদের যাদের সমর্থন দরকার, তাদেরকে সমর্থনে নেওয়ার জন্য, অন্তত নিরপেক্ষ করার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করছেন। বেগম জিয়া যদিও বলেছেন, ঈদের পর আরও বৃহত্তর আন্দোলনের কর্মসূচি দেবেন এবং জঙ্গি আন্দোলনের কর্মসূচি দেবেন। আমি মনে করি, সেটাও নির্ভর করবে কতটা এই শক্তি-সাম্য তিনি তার পক্ষে আনতে পারবেন।

লেখক : রাজনীতিক

ই-মেইল : mrmanna51@yahoo.com

মঙ্গলবার, ১৯ জুন, ২০১২

বিএনপির আন্দোলন

মাহমুদুর রহমান মান্না


বেগম জিয়া এবং বিএনপি বেশ ধীরগতিতে এগুচ্ছে এ কথা তাদের ১১ জুনের গণসমাবেশ দেখে বোঝা যায়। কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রথমত আমি বলব, এ লেখা আমি যেদিন লিখছি সে সময়ের ভেতরে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে অনেক নেতা মুক্তি পেয়েছেন। যদিও এটা সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে কোনো সমঝোতার ইঙ্গিত দেয় বলে মনে করি না। যারা মুক্তি পেয়েছেন তাদের অন্যতম বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মাজারে পুষ্পস্তবক দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর সাংবাদিকদের বলেছেন, বিএনপিকে ভাঙা যাবে না। গ্রেফতার-নির্যাতন দলকে আরও সংগঠিত করেছে। বিএনপিকে ভাঙার ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়েছে। বিএনপি এখন আগের চেয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। কথার মধ্যে খানিকটা বিশ্বাস আনা যায় এ বিবেচনা থেকে যে, ১১ তারিখের গণসমাবেশ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সেই কথাকে সত্য প্রমাণ করেছে। একটা প্রচণ্ড চাপের ভেতরে ছিল বিএনপি। একসঙ্গে ৩৩ জন নেতা গ্রেফতার হয়েছিলেন। প্রায় সবাই ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় রাতে লুকিয়ে থাকতেন। দিনে কাজকর্ম করতেন। আমরা বলি যাকে আত্দগোপন বা আধা আত্দগোপন করা। দেশব্যাপী তাদের প্রতি এ চাপ অব্যাহত ছিল। এর পরও যে ১১ তারিখে এ রকম একটা গণসমাবেশ করা যাবে বা তারা করতে পারবে সেটা ঠিক বোধগম্য হয়নি অনেকের। সে তুলনায় তাদের গণসমাবেশ সফলতা লাভ করেছে বলেই আমার বিশ্বাস।

সে সময় সবার ধারণা ছিল, এত নেতা গ্রেফতারের পর যেহেতু এখন পর্যন্ত তাদের মুক্তির আলামত দেখা যাচ্ছে না, তাই বেগম জিয়া কোনো কঠোর কর্মসূচি দেবেন। কিন্তু বেগম জিয়া যে কর্মসূচি দিয়েছেন, এককথায় বলা যায়, তা ঠাণ্ডা মেজাজের এবং পরিমিত মাপের একটি কর্মসূচি। অনেকেই সমালোচনা করেছেন, বিএনপি আসলে আন্দোলন থেকে পশ্চাদপসরণ করছে। তারা এত চাপ নিতে পারছে না এবং বিএনপি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করার জন্য আমি বলতে চাই, বিএনপি এবং তার নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বেশ ধীরে-সুস্থে চিন্তাভাবনা করে এগুচ্ছেন।

আমার বন্ধু এবং সমালোচকদের অনেকে ভ্রু কোঁচকাবেন। ব্যাপার কি! মাহমুদুর রহমান মান্না বেগম জিয়ার প্রশংসা করতে লাগলেন কেন? ডাল মে কুচ কালা আছে না কি? আমি ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করছি। প্রথমত প্রশ্ন_ এ সময়ের আন্দোলনের কর্মসূচি কি হতে পারত। আমাদের দেশে কঠোর কর্মসূচির অর্থ হচ্ছে হরতাল। অথচ হরতালের বিরুদ্ধে এক ধরনের গণচেতনাই গড়ে উঠেছে বলা যেতে পারে। মানুষ বিরোধী দলের আন্দোলনকে সমর্থন করলেও হরতালকে সমর্থন করছে না। সে পরিস্থিতিতে হরতাল নয় অথচ কঠোর কর্মসূচির ধরন কি_ সংকটকালে যখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল আর আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে ছিল তখন কর্মসূচি দেওয়া নিয়ে এ প্রশ্ন উঠেছিল। আমাদের দেশে যারা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তারা মনে করেন হরতাল হচ্ছে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিবাদের মাধ্যম। এ জন্য এটা বুঝেশুনে ব্যবহার করতে হবে। অতিরিক্ত ব্যবহার এর কার্যকারিতা নষ্ট করে ফেলতে পারে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, এ আন্দোলনকে তার চূড়ান্ত বা যৌক্তিক পরিণতিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য কর্মসূচিগুলোর বিন্যাস কেমন হবে, তার ধাপ কিরকম হবে, কিভাবে একধাপ থেকে আরেকটি উন্নত ধাপে সেই কর্মসূচি যাবে। বর্তমান ক্ষেত্রে মাঝখানে রোজার মাস, এর পর ঈদ। অতএব, এ কর্মসূচির ধারাবাহিকতা যে রক্ষা করা যাবে সেটা বলার কোনো কারণ নেই। অতএব, বিএনপি যদি কর্মসূচি দিত বড়জোর রমজানের আগে একটি বা দুটি হরতাল দিতে পারত। এর পর তাদের আবার রোজার মধ্যেই যেতে হতো। সে ক্ষেত্রে বেগম জিয়া হরতাল পরিহার করেছেন এবং সমাবেশ-বিক্ষোভের ভেতরে তার কর্মসূচি সীমাবদ্ধ রেখেছেন। আন্দোলনের আবহ বা মেজাজ ধরে রাখার জন্য তিনি খুব দৃঢ়ভাবে ঘোষণা দিয়েছেন, কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে রোজার পর। এখানে বিএনপি বা বেগম জিয়াকে বোঝার ব্যাপার।

কিন্তু এর আগে আমি একটি কথা বলতে চাই_ বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল বিরোধী দল আওয়ামী লীগ বা জোট হিসেবে ১৪ দল বা পরবর্তীতে মহাজোট আন্দোলন করে আসছিল, তখন মহাজোটের খুব শক্তিশালী লাগাতার কঠোর কর্মসূচি সত্ত্বেও বিএনপি বা চারদলীয় জোট ক্ষমতায় ছিল। পাঁচ বছরের টার্ম পূর্ণ করার পর তারা ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিল ইয়াজউদ্দিনের হাতে। এত বড় জোটের আন্দোলন তাদের ক্ষমতা থেকে অপসারণ করতে পারেনি। আমাদের এ এলাকায় সফল গণঅভ্যুত্থানের একটি মাত্র নজির, সেটি হচ্ছে '৬৯, যাতে আইয়ুবশাহী শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়।

সেই আন্দোলনের পর আইয়ুব খান ক্ষমতা থেকে যে চলে গেছেন সেটা ঠিক উৎখাত করা বলা যায় কি? গণঅভ্যুত্থান পশ্চিম পাকিস্তানে হয়নি কিন্তু উভয় (পূর্ব-পশ্চিম) পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে বাস করা সত্ত্বেও। '৬৯-পূর্ব পাকিস্তানে যে অভ্যুত্থান হয়েছিল সেরকম কিছু পশ্চিম পাকিস্তানে হয়নি সেখানে এমন কোনো রাজনৈতিক-প্রশাসনিক চাপ তৈরি হয়নি যে, আইয়ুব খানকে পদত্যাগ করতেই হতো। আমি বলতে চাচ্ছি, ওর চেয়ে অনেক বড় আন্দোলন বেগম জিয়ার আমলে মহাজোট করেছিল কিন্তু বেগম জিয়ার পাঁচ বছরের শাসনকালকে একদিনের জন্যও কমিয়ে আনতে পারেনি। তার মানে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার উৎখাত করে সে জায়গায় কোনো বৈপ্লবিক সরকার বা জাতীয় সরকার বা গণতান্ত্রিক সরকার প্রবর্তনের ইতিহাস বা উদাহরণ স্বাধীন বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত নেই।

বেগম জিয়ার যে আন্দোলন, সে আন্দোলন শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে যাবেন তিনি। তিনি কি টার্গেট করছেন? যদিও বক্তৃতায় আমরা মাঝে মাঝে শুনছি সরকার পতনের আন্দোলন, কিন্তু সরকার যদি পাঁচ বছর পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে চায় তাহলে কি তা থেকে তারা সরিয়ে দিতে পারবেন? পতন ঘটাতে পারবেন? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য বলেছেন, তিনি নির্ধারিত সময়ের তিন মাস আগেই নির্বাচন দেবেন। আর এখন তিনি এক ধরনের বলা যেতে পারে যে, নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন। বিভিন্ন সভা-সমিতিতে নির্বাচনের জন্য দলকে প্রস্তুত হওয়ার জন্য বলছেন। পর্যবেক্ষকরা বোঝে, এটা যতখানি না তার দলকে প্রস্তুত করার কথা বলা হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি করে বোঝানো হচ্ছে, নির্বাচন কিন্তু আসছে। নির্বাচনের একটা আবহ তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বেগম জিয়া আন্দোলন করে এ সরকারের পতন ঘটাবেন বা উৎখাত করে ফেলতে পারবেন_ এ রকম বিশ্বাস হয়তো তারা করেন না। আমার মনে হয়, বিএনপি সেরকম কোনো লক্ষ্য নিয়ে আন্দোলন করছে না। তারা বলছে বটে। কিন্তু তাদের মূল টার্গেট হচ্ছে একটি দলনিরপেক্ষ সরকার গঠন করা এবং তার অধীনে জাতীয় সংসদের নির্বাচন করা। বিএনপি তত্ত্বাবধায়কের দাবি থেকে সরে এসে বলছে অন্তর্বর্তী বা যে নামেই ডাকা হোক তা যেন দলীয় সরকার না হয়।

গত সাড়ে তিন বছরে স্থানীয় সরকারসহ জাতীয় সংসদের একটি দুটি উপনির্বাচনে জিতে বেগম জিয়া বা বিএনপির সম্ভবত এ ধারণা জন্মেছে যে, মোটামুটিভাবে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে তার দল ক্ষমতায় যেতে পারবে। তা ছাড়া গত সাড়ে তিন বছরের শাসনে মহাজোট সরকার যে অনেক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, অনেক জনপ্রিয়তা হারিয়েছে তা এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। খোদ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, গতবারের ২৩৩ আসনের তুলনায় এবার তার দল ১৭৫ আসনে জিতবে। প্রথম আলোর সোহরাব হাসান লিখেছেন সাড়ে তিন বছরে যদি এ অবস্থা হয় তবে বাকি দেড় বছরে আসন সংখ্যা ৭৫ হয়ে যাওয়া অসম্ভব কি? অতএব সবকিছু দেখেশুনে বিএনপি এমন কিছু করতে চাচ্ছে না, যাতে সেই নির্বাচন ব্যাহত হতে পারে বা সুদূরপরাহত হতে পারে। আমি খুব দূরবর্তী হলেও এটা ইঙ্গিত করতে চাচ্ছি, যদি উভয় দল অনড়-অটল-অচল থেকে কেবল লড়াই করতে থাকে, তাহলে তার মধ্য থেকে যে তৃতীয় শক্তির আবির্ভাবের, অভ্যুদয়ের এমনকি ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনাও তৈরি হয়। সম্ভবত বিএনপি বা বেগম জিয়া সেরকম কোনো পরিস্থিতির জন্ম দিতে চান না। তারা মনে করছেন, সরকার এ ব্যাপারে যদি দায়িত্বশীল আচরণ নাও করে, তাদের সে ব্যাপারে দায়িত্বশীল আচরণ করা উচিত। আমি বলছি না সরকার দায়িত্বশীল আচরণ করছে না। আমি শুধু বলছি, একপক্ষীয়ভাবে হলেও বিএনপি এ রকম একটি কৌশল নিয়েছে। সেই কৌশল নেওয়ার পশ্চাতে এমনও হতে পারে, আসলে তারা সাংগঠনিকভাবে অত দৃঢ় নন, অত লড়াকু নন যে, কৌশল নেবে মারব অথবা মরব সরকারকে ফেলব অথবা পড়ে যাব। এ রকম কোনো কিছু ভাবছেন না। তারা মনে করছেন, গণতান্ত্রিকভাবে একটি নির্বাচন আদায় করাই তাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। তাহলে তারা জিততে পারবেন। আমি বলব, সেই বিবেচনা থেকে বেগম জিয়া যে কর্মসূচি দিয়েছেন তার কিছু এদিক-ওদিক পার্থক্য হতে পারত কিন্তু দৃশ্যমান অনুভব করা এ রকম কোনো কঠোর কর্মসূচির মধ্যে তিনি যেতে পারতেন না। এ কৌশল কি তাদের ক্ষমতায় নিয়ে যেতে পারবে? সে কথা পরের একটি সংখ্যায়- ।

লেখক : রাজনীতিক

ই-মেইল : mrmanna51@yahoo.com

মঙ্গলবার, ১২ জুন, ২০১২

আবার গণতন্ত্র ও নাগরিক আন্দোলন নিয়ে কথা

মাহমুদুর রহমান মান্না


নাগরিক আন্দোলন বা সিভিল সোসাইটির আন্দোলনের কথা বলা হচ্ছে কেন? আমি একটি উদাহরণ দেই। আমার ছেলে এ বছর এ-লেভেল পরীক্ষা দিয়েছে। সবাই জানেন হরতালের কারণে এ-লেভেলের ছাত্রছাত্রীদের ছুটির দিন রাত ১২টার সময় পরীক্ষা দিতে হয়েছে। আমি কয়েকজনকে প্রশ্ন করেছি_ কেন এমন হবে?

এক নদী রক্ত সাঁতরিয়ে আমরা যে দেশ স্বাধীন করেছি সে দেশে গভীর রাতে পরীক্ষা অনুষ্ঠানের মতো কাজ হবে কেন? আমরা তো কোনো অপকর্ম করিনি? আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করেছেন শ্রোতারা। বলেছেন, এ জন্য তো আপনারাই দায়ী। যেহেতু আমি আওয়ামী লীগ করি, আমি প্রশ্ন করলে মানুষ তো পাল্টা প্রশ্ন করতে পারে। যিনি বিএনপি করেন তাকেও মানুষ একইভাবে প্রশ্ন করবে_ হরতাল তো আপনারা ডেকেছেন, আপনারা কাকে প্রশ্ন করেন। এ জন্য এ প্রশ্ন করার অধিকার সেই ধরনের মানুষের বেশি, যারা কোনো দল করেন না। যারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট তাদের সে অধিকার ততটা নেই।

সর্বশেষ অবস্থার কথা বলি। ১১ জুনের কথা। কি হলো তা সবাই আপনারা দেখেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবিতে বেগম জিয়া হালকা কর্মসূচি দিলেও ঈদের পরে কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। পরিস্থিতি স্পষ্ট জানান দেয় যে, সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে কোনো সমঝোতা হচ্ছে না। জামিন পেলেও বিরোধী দলের নেতারা ১১ তারিখ গণসমাবেশের আগে মুক্তি পাননি। তার মানে উভয় পক্ষের মধ্যে সংলাপ ইত্যাদি নিয়ে যে কথা বলা হয়েছিল তা হচ্ছে না। পরিস্থিতি সংঘাতের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

আমাকে ভুল বোঝার কোনো অবকাশ নেই। আমি রাজনৈতিক দল করার বিপক্ষে কোনো বক্তব্য দিচ্ছি না। আমি বরঞ্চ মনে করি, রাজনীতির বাইরে আমাদের সমাজের কোনো সমস্যার সমাধান শেষ পর্যন্ত হবে না। কিন্তু কোনো কোনো সময় থাকে মানুষ যখন রাজনীতির ওপর বিতৃষ্ণা হয়। এখন হলো তেমন একটি সময়। তার অর্থ আবারও সংঘর্ষ হবে, আবারও মানুষ মারা যাবে। আবার বাস পুড়বে। বাসের ড্রাইভার মারা যাবে, টেম্পোর ড্রাইভার মারা যাবে। কিংবা অফিসগামী কোনো নিরীহ মানুষ মারা যাবে। এ মৃত্যু উপত্যকার মধ্যে আমরা কেন বাস করব? কেন এ অবস্থার অবসান চাইব না? প্রশ্ন হলো, এ অবসান রাজনৈতিক দলগুলো কি চাইতে পারবে? রাজনৈতিক দল দুটির নেতাকর্মীরা এ বিষয়ে তাদের দলের প্রধান নেতা বা নেত্রীর সঙ্গে আলোচনা করতে পারবে? উভয় দলের মধ্যে লব্ধ প্রতিষ্ঠিত সর্বজনবিদিত অনেক নেতা আছেন। তাদের কি এ বিষয়ে শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলতে দেখেছেন?

একদিন আগে যিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে বলেছেন, একদিন পর তিনি তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন_ এটা কি আমরা দেখছি না? একই কথা কি বিএনপি সম্পর্কেও প্রযোজ্য নয়? এ কারণে নাগরিক সমাজের প্রশ্ন আসছে। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে আন্দোলন করতে পারছে না কিংবা এ সময় আন্দোলনে নামছে। সেহেতু নাগরিক সমাজকে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হচ্ছে। প্রাসঙ্গিকভাবে বাংলাদেশের জন্য আরেকটি কথা বলি। আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে মিলে এক সময় গণতান্ত্রিক আন্দোলন করতে নেমেছিল। সবারই মনে থাকার কথা, শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে সে পথ থেকে সরে আসতে হয়েছিল। কি কারণে? কারণ আওয়ামী লীগকে সমর্থনকারী মানুষ যারা গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি আস্থাশীল, তারা চাপ সৃষ্টি করেছিল। আমিও উপস্থিত ছিলাম সে ধরনের কয়েকটি সভায়। সেখানে অনেকে রীতিমতো তর্ক জুড়েছেন। তারা স্পষ্টভাবে বলেছেন, এ রাজনীতি আওয়ামী লীগের হতে পারে না। এটা কি একটি আন্দোলন নয়? সেই আন্দোলনে সিভিল সোসাইটি ভূমিকা রেখেছে। তারা বিএনপি বা কারোর হয়ে আন্দোলনে যায়নি।

গত লেখায় ১ জুন নাগরিক সমাবেশের যে কথা আমি বলেছিলাম সেখানে বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক উল হক বলেছেন, মাহমুদুর রহমান মান্না কি উদ্যোগ নিতে পারেন না, যাতে দুই নেত্রীর বসা সম্ভব হয়। এ দুই নেত্রী বসে আলাপ-আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করবেন। আমি সেদিন যে কথা বলেছিলাম সে কথা আজও বলছি। দুই নেত্রী কেন বসবেন? একটা হয়। নেলসন ম্যান্ডেলা যেমন বলেছেন, আমরা যখন পরস্পর বিবদমান, তর্কে লিপ্ত গ্রুপগুলো বসি তখন আমরা এ বিবেচনা করি না যে, আমি জিতলাম না সে জিতল। আমাদের বিবেচনা করতে হয় দেশ জিতল কিনা? আমাদের দুটি দলের মধ্যে এই বোধ কি আছে? দুই নেত্রী যদি বসেন তবে হিসাব করবেন আমি জিততে পারব তো? যতক্ষণ পর্যন্ত এ হিসাব না মিলবে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা বসার কথা ভাববেন না। যদি প্রচণ্ড কোনো আন্তর্জাতিক চাপ আসে, যার সামনে দুই বড় নেত্রী মাথানত করতে বাধ্য হন_ তবে তারা বসতে পারেন। আরেকটা হতে পারে। যেটি হলো নাগরিক সমাজের আন্দোলন। লাখো জনতা যদি বলে, হয় আপনারা সমস্যার সমাধান করবেন অথবা পথ ছেড়ে দেবেন, তাহলে হতে পারে। মানুষ এতদূর এগিয়ে এলে অনেক কিছুই সম্ভব।

এত প্রতিপত্তিশালী প্রধানমন্ত্রী বিমানবন্দর নির্মাণ করতে গিয়ে জমি দখলের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের আন্দোলনের সামনে কি নতিস্বীকার করেননি? আমাদের দুই নেত্রী যত বড়ই হোন কেউই জনতার চেয়ে বেশি শক্তিশালী নন। আমি উদাহরণ হিসেবে মাঝে মাঝে বলি, আন্না হাজারে ভারতবর্ষে যে অনশন করেছেন সেই অনশনে শক্তি দেখিয়েছেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করে। শেষ পর্যন্ত তিনি জিতেছেন। আমাদের দেশের টিআইবি নামের একটি সংগঠনের কথা এ প্রসঙ্গে বলা যায়। যদিও এটি একটি এনজিও, তবে তারা দুর্নীতি নিয়ে অনেক কাজ করছে। দুর্নীতি নিয়ে প্রচুর অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে দেশে এখনো কোনো নাগরিক আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। নাগরিক আন্দোলনের কথা কেন বলছি? কোনো দল যখনই দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে তখন বলা হবে, তোমরা অতীতে এটা করেছ। আর এখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলছ। তোমরাও তো দুর্নীতিবাজ। কিন্তু এ রকম ছাপ যাদের নেই_ ব্যারিস্টার রফিক উল হক যেমন বলেছেন, যাদের গায়ে গন্ধ নেই তারা যখন মাঠে নামবেন, পথে নামবেন তখন নিশ্চয়ই তার পেছনে জনগণ আসবে।

এই যে নাগরিক আন্দোলনের কথা বলা হলো, তারা কিন্তু নিজেদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা দাবি করছে না। স্পষ্টতই তারা আওয়ামী লীগবিরোধী নয়, বিএনপিবিরোধীও নয়। তারা যেমন উভয়ের বিরুদ্ধে আবার উভয়ের পক্ষে। তারা চায় উভয় দল যতদূর সম্ভব পরিশীলিত হয়ে গণতন্ত্রসম্মত হয়ে জনকল্যাণধর্মী হয়ে মানুষের সামনে আসুক। আমরা সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য যেখানে দুটি শক্ত-পোক্ত-অভিজ্ঞ-সমৃদ্ধ দল দরকার, সেখানে অযথা তাদের নিন্দা করে ছোট করে দেশের লাভ হতে পারে না। আমি আবারও বলছি, আওয়ামী লীগ বা বিএনপিকে খাটো করবে কোনো আন্দোলনের এমন লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। তবে আমরা চাই বা না চাই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা তাদের আচরণ ও উচ্চারণে নিজেরা ছোট হচ্ছেন এবং দলকে ছোট করছেন। এই ছোট হতে হতে এমন ছোট হন যে, তারা জনগণের হাঁটুর নিচে চলে যান। সে বোধ যেন তাদের মধ্যে থাকে। তখন সংবিধানবহিভর্ূত শক্তির ক্ষমতা দখলের প্রশ্ন ওঠবে। যা ইতোমধ্যে উঠছে এবং সরকারি দলই সেটা বেশি করে তুলছে। কেন? এত যে বড় গলায় হৈচৈ করে পঞ্চদশ সংশোধনী করা হলো এবং সেখানে বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে বিশেষ ধারা-উপধারা যুক্ত করা হলো, এর পরও এ প্রশ্ন কেন আসবে? তার মানে কি এসব ধারা-উপধারা দিয়ে সামরিক শাসন রোধ করা যাবে না? এগুলোর কি কোনো মূল্য নেই? তাহলে এগুলো আনলেন কেন?

আমেরিকা ইউরোপ এমনকি ভারতে কখনো সামরিক আইনের প্রশ্ন আসে না কেন? কারণ সেখানে এটি আসার মতো কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক ভিত্তি নেই। আমাদের এখানে এর রাজনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তি তৈরি হয়। আমরাই তা তৈরি করি। আমি মনে করি, সামরিক আইন বন্ধ করার বিষয়টি মূলত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সাফল্যের ওপর নির্ভরশীল। দুটি দলের পারস্পরিক আচরণ, পরস্পরের প্রতি সহনশীলতা, সহমর্মিতা এবং তার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিকতা গড়ে তোলার ওপর নির্ভরশীল। আমি বলতে চাই, সিভিল সোসাইটি বা নাগরিক আন্দোলন_ এই গণতান্ত্রিকবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ গড়ে তোলার কাজে সহায়ক। তারা এ ক্ষেত্রে কোনো আপস করবে না। রাজনৈতিক দলের নেতা তার চেয়ে বড় নেতার সঙ্গে আপস করে। এক দল আরেক দল নেতার কাছে স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আপস করে। কিন্তু সিভিল সোসাইটির এ আন্দোলন আপস করবে না। তারা আওয়ামী লীগের জন্যও আপস করবে না, বিএনপির জন্যও আপস করবে না। তারা মূলত জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত থাকবে। সিভিল সোসাইটি সব সময় গণতন্ত্রের সহায়ক শক্তি। গণতন্ত্র বিনির্মাণে রত রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়ক শক্তি। তাদের সে রকম করে বোঝাই উচিত। এ শক্তি কি কখনো রাজনৈতিক দল হতে পারে? স্বাভাবিকভাবে না। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে এ রকমভাবে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবিভর্ূত হয়েছে এর প্রমাণ অনেক আছে। জার্মানির গ্রিন মুভমেন্টের কথা আমরা জানি। এটি নাগরিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েই গড়ে উঠেছে। পোল্যান্ডে লেচ ওয়ালেসার সলিডারিটি মুভমেন্ট এরকম আরেকটি উদাহরণ হতে পারে। নাগরিক আন্দোলন গণতন্ত্র প্রশিক্ষণের একটি কেন্দ্র হতে পারে। এখান থেকে অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব গড় উঠতে পারে। তবে নাগরিক আন্দোলন নিজে থেকে নিশ্চয়ই কোনো রাজনৈতিক দল নয়। অতএব, রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের প্রতিপক্ষ মনে করা উচিত নয়।

লেখক : রাজনীতিক

ই-মেইল : mrmanna51@yahoo.com

বৃহস্পতিবার, ৭ জুন, ২০১২

সংসদের অবমাননা আসলে কে করেছেন?


মাহমুদুর রহমান মান্না
ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে নিয়ে সংসদে আলোচনা ঠিক হয়নি বলে অভিমত দিয়েছেন। তবে সেটা বলা হয়েছে সংসদের বাইরে। সংসদে ৩ জুন যারা আলোচনা করেছেন তারা এ ধরনের মন্তব্য করার আগে একটু কি খতিয়ে দেখতে পারতেন না যে তিনি কী বলেছেন? এ কাজ কি যোগাযোগের আধুুনিক তথ্যপ্রযুক্তি যাদের হাতে তাদের জন্য কঠিন কিছু ছিল? উগ্র আবেগের বশে কিংবা ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে তারা যা বলেছেন তাতেই তো সংসদকে খাটো করা হয়েছে

ক্ষমতাসীনদের আচরণ ও উচ্চারণে কার্যকর গণতন্ত্র-পরমতসহিষ্ণুতার প্রচণ্ড অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে, এ অভিমতের বিষয়ে বোধকরি অনেকেই সহমত পোষণ করবেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে ৪১ বছর হয়ে গেল। এ সময়ের পর্যালোচনায় গেলে দেখা যাবে, আমরা গণতন্ত্র পেয়েছি অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যা পেয়েছি তা হচ্ছে নির্বাচন। বলা যায়, ভোটের অধিকার পেয়েছি। বারবার এর প্রয়োগ হচ্ছে। আমরা এই নির্বাচনকেই মনে করছি গণতন্ত্র_ নির্বাচিত সরকার থাকা মানেই গণতন্ত্র থাকা। এ ভূমিকা এ কারণে দেওয়া যে এ বিষয়টি স্পষ্ট না থাকলে পরবর্তী যে সংকট_ গণতন্ত্রের যে সংকট সেটা ঠিকভাবে বোঝা যাবে না। স্বাধীন দেশের একেবারে যাত্রা থেকেই যারা ক্ষমতায় ছিলেন বা রয়েছেন, পরমতের প্রতি তাদের সহিষ্ণু মনোভাবের বড়ই অভাব দেখছি। যার জন্য স্বাধীনতা অর্জনের চার বছর যেতে না যেতেই বঙ্গবন্ধুকে সারাজীবনের লালিত স্বপ্ন ও সংগ্রামের অর্জন সংসদীয় গণতন্ত্র ভেঙে একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় যেতে হয়েছে। সেই একদলীয় ব্যবস্থা থেকে আবার আমাদের উত্তরণ ঘটেছে বহুদলীয় ব্যবস্থায়। তবে এটা গণতান্ত্রিকভাবে ঘটেনি, বরং হয়েছে সঙ্গিনের খোঁচায়। তাতে একদলীয় ব্যবস্থা বিদায় নিয়েছে, কিন্তু এক ব্যক্তির শাসন_ রাষ্ট্রপতির শাসনে পরিবর্তন হয়নি।
এই যে এত বড় পরিবর্তন, যা অভিহিত হয় ঐতিহাসিক হিসেবে, তার পেছনে কতটা রাজনীতি-সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি, সব মিলিয়ে আমাদের কী ভুল ছিল, কতটা ভুল ছিল, ভুল হয়ে থাকলে কেন হয়েছিল, শুদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়া সঠিক ছিল কি-না_ এসব মূল্যায়িত হওয়া তো দূরের কথা, এমনকি তা নিয়ে মুক্তমনে আলোচনাও হয়নি। আমি বলতে চাইছি, মত ও পথের ভিন্নতা এবং তার মিথস্ক্রিয়া, যা দিয়ে গণতন্ত্র নির্মিত হয়_ সেটা বাংলাদেশে কখনও হয়নি। গণতন্ত্র কেবলই একটি শাসনব্যবস্থা নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মূল্যবোধ এবং নীতি ও নৈতিকতা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে, কিন্তু সেই সংস্কৃতির বিষয়ে এভাবে আমরা কখনও চর্চা করিনি। দিনে দিনে রাজনীতিতে তাই পরমতসহিষ্ণুতার বদলে অসহিষ্ণুতা প্রকট। ভিন্নমতকে যে কোনো প্রকারে পরাস্ত করার প্রবণতা দেখা দিয়েছে এবং যা শেষ পর্যন্ত সাংস্কৃতিক রূপ নিয়েছে। আমরা এত অধৈর্য হয়ে পড়েছি যে সংবাদপত্র কিংবা বেতার-টেলিভিশনের যে স্বাধীনতার কথা মুখে বলছি, তার মানে কী তা বুঝতে পারছি না কিংবা সে চেষ্টাও করছি না। সংবাদপত্র-টেলিভিশনের মতো গণমাধ্যমে যা কিছু ভিন্নমত প্রকাশ করা হচ্ছে তার প্রতিও আমরা রুষ্ট হয়ে পড়ছি।
সংসদীয় ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের বিমূর্ত, ব্যক্তিকৃত যে রূপ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী_ তিনি পর্যন্ত অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছেন। ইতিপূর্বে তিনি দু'একবার বক্তৃতায় টেলিভিশন টক শো যারা করেন তাদের কঠোর সমালোচনা করেছেন এই বলে যে, তারা গভীর রাতে ছোট বাক্সে নিজেদের পাণ্ডিত্য দেখান, কিন্তু কোথাও জনগণের মতামত যাচাই করার ক্ষমতা রাখেন না। কোনো এলাকায় ভোটে দাঁড়ালে তাদের জামানত থাকবে না। তিনি এমনকি কোথাও কোথাও তাদের এক-এগারোর সমর্থক হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন। কী অবাক ব্যাপার। দেশের ১৬ কোটি মানুষ তো ভোটে দাঁড়াবে না। তাদের সবাই নির্বাচনে দাঁড়ানোর কথা ভাবেও না। তার মানে কি এই যে, তারা গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি, সরকার, বিরোধী দল, রাজনীতি_ এসব নিয়ে কথা বলতে পারবে না? আর ভোটে জয়ী হওয়াই কি সব? পৃথিবীর যত বড় বিজ্ঞানী কিংবা কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক, তারা ক'জন ভোটে দাঁড়িয়েছেন? বিজ্ঞানীদের যে আবিষ্কার, যা মানবজাতিকে আলোকিত করে চলেছে সেসব কি ভোটে দেওয়ার প্রশ্ন আসে? পৃথিবী যে সূর্যের চারদিকে ঘোরে সেটা যদি বাংলাদেশ বা অন্যত্র জনতার ভোটে ফেল করে তাহলে কি মিথ্যা হয়ে যাবে? আমি বলতে চাইছি, সত্য কখনও সংখ্যালঘিষ্ঠ বা সংখ্যাগরিষ্ঠের ওপর নির্ভর করে না। জ্ঞানচর্চার সঙ্গে ভোটের কোনো সম্পর্ক নেই।
প্রধানমন্ত্রী চার-পাঁচ দিন আগেও যারা টক শো করেন তাদের আরেক হাত নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এরা সরকারের অর্জনের কথা বলে না। কেবল সমালোচনা করে। মিথ্যা প্রচার করে। তিনি এবং তার সরকার গ্রামের দরিদ্রদের জন্য, বঞ্চিত মানুষের জন্য কাজ করে চলেছেন। তাদের কিছু দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এই 'টক শো'ওয়ালারা কিছু পায় না, তাই যত রাগ। এ জন্যই সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করে। আবার কিন্তু সেই ধৈর্য পরীক্ষার প্রশ্ন এসে যায়। টক শোতে যারা যান তারা সাধারণত তাদের দায়িত্ববোধ থেকে কথা বলেন। একটা রেওয়াজ আমরা দেখেছি_ এ ধরনের অনুষ্ঠানের অতিথি হিসেবে একজন সরকারি দল এবং একজন বিরোধী দলের নেতা বা বুদ্ধিজীবী থাকবেন। আজকাল সে রেওয়াজ মানা যাচ্ছে না। কারণ সরকারি দলের লোকজন টেলিভিশনে টক শোতে আসতে তেমন আগ্রহ দেখান না। আমার কথা হলো, সরকার দুটি কাজ করতে পারে। এক. এ পর্যন্ত টক শোতে আলোচনায় কী কী মিথ্যাচার হয়েছে তা উল্লেখ করে তার সত্যায়িত বিবরণ গণমাধ্যমে প্রকাশ করা। দুই. সরকারি দলের নেতারা টেলিভিশন টক শোতে আরও বেশি করে আসবেন এবং নিজেদের কথা বলবেন। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, আমার পরিচালনায় উপস্থিত দু'জন অতিথি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছেন, তারা কোনোদিন সরকারি কোনো বিশেষ সুবিধা নেননি। এটা তারা চাননি এবং চাইবেনও না। সরকার এ ধরনের বিশেষ কী কী সুবিধা, অনুকম্পা, টক শোর অতিথিদের দিয়েছে এবং পরে যা প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে ক্ষেপেছে, তার কোনো বিবরণ দিতে পারবে কি?
এতসব কথা এসে গেল কেবল একটি কথা বলার উপক্রমণিকা হিসেবে। ৩ জুন জাতীয় সংসদে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একটি বক্তব্যের ওপর একটি ঝড় বয়ে গেছে। ভয়ানকভাবে ক্ষিপ্ত একজন সাবেক মন্ত্রী, একাধিক সিনিয়র সংসদ সদস্য এবং তখন সংসদের স্পিকারের দায়িত্ব পালনরত আলী আশরাফ এ বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা বলতে চেয়েছেন, টিআইবির আলোচনায় বক্তব্যের মাধ্যমে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ভোটারদের অবমাননা করেছেন।
গড়পড়তা সংসদ সদস্যদের চোর-ডাকাত বলা নিশ্চয়ই ঠিক নয়। কিন্তু ভোটে জিতে কোনো কোনো সাংসদ কি চুরি-ডাকাতি করতে পারেন না? এটা ঘটলে তাদের চোর বলা হলে কি ভোটারদের অপমান করা হবে? কোনো কোনো সংসদ সদস্য সেখানেই থেমে থাকেননি। তারা এ বক্তব্যকে গণতন্ত্র ও সংসদের ওপর আঘাত হিসেবে অভিহিত করেছেন। তারা এমনও বলেছেন, যেসব বুদ্ধিজীবী সরকারের সমালোচনা করেন তাদের আয়ের উৎস কী তা খতিয়ে দেখুন। এক-এগারোতে তারা কী করেছেন, তা আমাদের জানা আছে। একজন শিক্ষক এত দামি গাড়িতে কী করে চড়েন? নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকলে তাদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। অনির্বাচিত সরকার থাকলে তারা পদ পান। স্পিকারের দায়িত্ব পালনকারী আলী আশরাফ সংসদের এ বক্তব্যকে যথার্থ মনে করেন। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের আকাশে কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে। সংসদ অবমাননার মাধ্যমে দেশের জনগণ ও সংবিধানের অবমাননা করা হচ্ছে। এতে সাংসদদের বিশেষ অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে। সে জন্য আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে বিশেষ অধিকার কমিটির মাধ্যমে নোটিশ করে আমরা এ সংসদে তলব করতে পারি। একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। তাকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। সংসদের অবমাননা করার অধিকার কারও নেই।
পাঠক, যদি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ঢালাওভাবে সাংসদদের চোর-ডাকাত বলতেন তাহলে নিশ্চয়ই তার বিরোধিতা করতাম। আলোকিত মানুষ সৃষ্টিতে অবদান রাখার জন্য নিশ্চয়ই তাকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু শ্রদ্ধা করি বলেই কারও চরিত্রহনন কিংবা চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার করে গালাগাল করতে পারেন না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাস্তবে ঘটনাটা কী?
সমকাল ও প্রথম আলোতে সংসদে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বক্তব্য নিয়ে যেদিন আলোচনা হয়েছে সেদিনই এ দুটি পত্রিকার প্রতিবেদকরা তার সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি তাদের জানান, দুর্নীতি কী তা বোঝাতে গিয়ে টিআইবির আলোচনায় বলেছেন, চোর যে চুরি করে, ডাকাত যে ডাকাতি করে সেটা কি দুর্নীতি? আমার ধারণা, এটা দুর্নীতি নয়। কারণ তাদের কোনো নীতিই নেই। সুতরাং দুর্নীতি সেই মানুষটি করে যার নীতি আছে। একটা উদাহরণ দিই। যদি একজন মন্ত্রী এই বলে শপথ নেন যে তিনি শত্রু-মিত্র ভেদাভেদ না করে সবার প্রতি সমান বিচার করবেন কিন্তু পরে সেটি না করেন, সেটা হবে দুর্নীতি।
তিনি বলেন, আলোচনায় সাংসদ শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি।
এরপর সংসদ কী বলবে? ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে নিয়ে সংসদে আলোচনা ঠিক হয়নি বলে অভিমত দিয়েছেন। তবে সেটা বলা হয়েছে সংসদের বাইরে। সংসদে ৩ জুন যারা আলোচনা করেছেন তারা এ ধরনের মন্তব্য করার আগে একটু কি খতিয়ে দেখতে পারতেন না যে তিনি কী বলেছেন? এ কাজ কি যোগাযোগের আধুুনিক তথ্যপ্রযুক্তি যাদের হাতে তাদের জন্য কঠিন কিছু ছিল? উগ্র আবেগের বশে কিংবা ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে তারা যা বলেছেন তাতেই তো সংসদকে খাটো করা হয়েছে।

মাহমুদুর রহমান মান্না : রাজনীতিক

মঙ্গলবার, ৫ জুন, ২০১২

সংলাপ হচ্ছে, সংলাপ হচ্ছে না!


মাহমুদুর রহমান মান্না 

দিন দশেক আগে এক ব্যবসায়ী নেতার বাড়িতে আওয়ামী লীগের এক প্রেসিডিয়াম সদস্যের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। কথায় কথায় তিনি বললেন, এই কয়েক দিন আগেও যে মনে হচ্ছিল বিএনপি আসুক আর নাই আসুক আওয়ামী লীগ নির্বাচন করবেই, তার পরিবর্তন হয়েছে। আওয়ামী লীগ এখন বিএনপিকেও নির্বাচনে আনতে চায়।
আমি খানিকটা বিস্মিত হয়েছিলাম। এবার ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকেই বিএনপির ব্যাপারে আওয়ামী লীগ কঠোর মনোভাব দেখিয়ে যাচ্ছিল। বিএনপির নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে উচ্ছেদ থেকে শুরু করে ৩৩ জন নেতার গ্রেপ্তার পর্যন্ত সেই দৃষ্টিভঙ্গিই প্রকাশ পাচ্ছিল। ইতিমধ্যে বেগম জিয়ার দুই পুত্রসন্তানের ব্যাপারেও কঠোর মনোভাব দেখিয়েছে সরকার। আমি কিছু বলতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগে সেখানে উপস্থিত আরেকজন ব্যবসায়ী বললেন, এটা যদি হয় তাহলে ধরে নিতে হবে আগামী নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় যাচ্ছে এবং সেটা মেনে নিতে প্রস্তুত আছেন শেখ হাসিনা।
এই ব্যবসায়ীও আওয়ামী লীগ করেন। এবং তিনি একটি দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন। এ পর্যন্ত যতগুলো নির্বাচন হয়েছে সেগুলো দেখে তাঁর এই ধারণা হয়েছে যে মোটামুটি সৎ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ তাতে হেরে যাবে। আমি সেই বিতর্কের মধ্যে গেলাম না। একটু ঘুরিয়ে সেই প্রেসিডিয়াম সদস্যকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার বক্তব্য কতখানি নির্ভরযোগ্য। কতখানি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে তা পাওয়া?
তিনি হাসলেন, বেশ প্রত্যয়ী হাসি। বললেন, আমাকে তো কেউ আর এভাবে বলেনি, অঙ্গভঙ্গি থেকে বুঝে নিয়েছি।
পাঠক, তত দিনে হিলারি-প্রণবসহ তিন নেতা বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন। কথায় কথায় সে প্রসঙ্গ এসে গেল, আমাদের দেশে রাজনীতিতে, ক্ষমতার পরিবর্তনে এদের ভূমিকা কতটুকু? যেভাবে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর ওখানে কিছু না খেয়ে একেবারে খালেদা জিয়ার বাসায় গিয়ে এক ঘণ্টা ধরে গল্প করলেন এবং পাটিশাপটা খেলেন তা কি কোনো কিছুর ইঙ্গিত বহন করে? এই যে সাড়ে তিন বছর ধরে সরকার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেল তার কি কোনো মূল্য নেই মার্কিন প্রশাসনের কাছে? এক ইউনূস ইস্যুতে আমেরিকা কি তাদের আন্তর্জাতিক নীতি বদলে ফেলবে? আর ভারত সরকার বিশেষত কংগ্রেস আওয়ামী লীগের বন্ধু। তাদের বাদ দিয়ে মার্কিনিরা এখানে নতুন নীতি নেবে।
এসব কথাও আলোচনায় এসেছিল। কিন্তু প্রেসিডিয়াম সদস্যের ওই একই কথা। আওয়ামী লীগ এককভাবে নির্বাচন করতে যাচ্ছে না। আমরা তিনজন তার কথায় একমত হইনি। আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা একা একাই সে রকম নির্বাচন করে ফেলতে পারবেন এবং সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়ে যাবে সে রকম কথা বলিনি আমরা। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকারের কাছ থেকে কোনো নমনীয়তা দেখা যাবে সে রকম বিশ্বাস করতে পারিনি।

দুই. 
এই লেখা শুরু করতে গিয়ে সেসব কথা মনে পড়ল। বিদেশি মেহমানরা বলেছিলেন দেশ গণতন্ত্রের পথে চলতে গেলে রাজনৈতিক দলগুলোকে পরস্পরের মধ্যে সংলাপ করতে হবে। নিজেদের সমস্যা নিজেরাই কথাবার্তা বলে নিষ্পত্তি করতে হবে। তখন দৃশ্যত কেউ গুরুত্ব দেয়নি সেসব কথায়। সরকারি দল তো দেশে যে কোনো রাজনৈতিক সংকট আছে তাই-ই মনে করে না। তবে কিসের কথা। তিন টার্ম আগে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া চলছিল না, তা তিন বছর আগে দানবে পরিণত হয়েছিল। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই দানবকে হত্যা করা হয়েছে। এখন যে সরকার আছে তা নির্বাচনের সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হয়ে যাবে। সমস্যা কী? এই তিন বছরে এই সরকারের অধীনে যত নির্বাচন হয়েছে তা তো খুবই সুষ্ঠু হয়েছে। অতএব, এই সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে।
এ রকমই যাচ্ছিল। আওয়ামী লীগ বলছিল, কথাবার্তা যদি কিছু বলার থাকে তাহলে সংসদে এসে বলুক বিএনপি। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কোনো কথা নেই। ওটা মারা গেছে। বেশ ভাব নিয়ে ছিল আওয়ামী লীগ। বিএনপি প্রতিবাদ করছিল, আন্দোলনের কর্মসূচি দিচ্ছিল, কয়েকটা হরতালও করেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ পাত্তা দিচ্ছিল না। আন্দোলনের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই আওয়ামী লীগকে। আওয়ামী লীগ হলো আন্দোলনের গাছ, আর বিএনপি আন্দোলনের ডালপালা। ওরা আবার কী আন্দোলন করবে।
কিন্তু হালে আওয়ামী লীগের এই হাবভাবে একটু টান পড়েছে। খোদ সাধারণ সম্পাদক সংলাপের আহ্বান জানিয়ে সতর্ক করে দিযেছেন, হয় সংলাপ, না হয় গৃহযুদ্ধ। দুই-একটি জাতীয় দৈনিক ঠিকই মন্তব্য করেছে আওয়ামী লীগে বরফ ভাঙতে শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য আগের মতোই বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। কিন্তু মানুষ ভাবছে, ওই সব বক্তৃতা করতে হয়। তাঁর অনুমতির বাইরে কি দলের সাধারণ সম্পাদক কথা বলেছেন?
মাত্র ১৫ দিন আগেও আমি এ রকম পরিস্থিতি ভাবিনি। কিন্তু এখন আমি ভাবছি, প্রেসিডিয়ামের সেই সদস্য ঠিক কথা বলেছিলেন। একটা কিছু হয়েছে জাতীয় বা আন্তর্জাতিকভাবে, যাতে কোনো দলের পক্ষে সংলাপকে অস্বীকার করা সম্ভব হচ্ছে না। বিএনপির তো সংলাপকে অস্বীকার করার প্রশ্নই আসে না। কারণ, তাদের মাথায় ঢুকে গেছে যেকোনোভাবেই নির্বাচন হলে তারা জিতবে।

তিন.
তাহলে কি সংলাপ হবে? হলে কী হবে? আমাদের এই দেশে সংলাপের সাফল্যের ইতিহাস তো নেই। এ রকম সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে আব্দুল জলিল-মান্নান ভূঁইয়ার সংলাপের ঘটনা তো সে দিনের। এবারও সংলাপ শুরুর আগে দল দুটি বাহানা কিন্তু ছাড়ছে না। আওয়ামী লীগ বলছে, সংলাপ হতে পারে কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কোনো কথা নয়। বিএনপি বেশ ঠান্ডা খেলছে। বাজারে রটে ছিল সরকারের চাপ বিএনপি সহ্য করতে পারবে না, দলটি ভাঙবে। কিন্তু সেটা সত্যে পরিণত হয়নি। বিএনপি বরং বলছে তারা এ রকম পরিস্থিতি তৈরি করতে চায় না, যাতে অন্য কেউ সুযোগ নিতে পারে। বেশ মজার ব্যাপার। সুযোগ পেলে এরা কেউ-ই ভালোমানুষি দেখাতে ছাড়ে না। কিন্তু বাস্তবে তারা কতখানি ভালো মানুষ তা নিয়ে মানুষের সন্দেহ রয়েই গেছে। আমি কেবল বলছিলাম, বিএনপি আওয়ামী লীগের ওই বাহানার জবাব দিয়েছে বেশ বুদ্ধি করে। তারা বলেছে যে নামেই ডাকা হোক তাদের আপত্তি নেই। কেবল একটি শর্ত, কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে পারবে না।
একভাবে বলা যায়, সংলাপ শুরু হয়ে গেছে এবং তা বেশ খানিকটা অগ্রগতিও লাভ করেছে। আওয়ামী মহল থেকে কথা হয়েছে অনির্বাচিত সরকার থাকতে পারবে না। কেউ কেউ প্রস্তাব করেছে, উভয় জোট থেকে সমানসংখ্যক সংসদ সদস্য নিয়ে একটা ব্যবস্থা করা যায় কি না। প্রশ্ন হলো সেই সংসদ সদস্যরাই কি তখন নির্বাচিত বলে গণ্য হবেন। একবার নির্বাচিত হলে তো আজীবনের জন্য নির্বাচিত হয়ে যান না। অতএব, এমপিদের রাখলেই সেটি নির্বাচিত সরকার হয়ে গেল এ রকম কোনো কথা নয়।
আমি বলছি না আনুষ্ঠানিক সংলাপ শুরু হয়েছে। কিন্তু এ কথা সত্যি, সমাজের মধ্যে এ নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। পত্রিকায় দেখলাম, আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গত সংলাপে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি আব্দুল জলিলও বলেছেন আওয়ামী লীগের অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে। তিনি এও বলেছেন, সমঝোতা না হলে পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে যাবে। তাঁর মানে কী দাঁড়াচ্ছে? আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বড় বড় নেতা বর্তমান পরিস্থিতি ও সমাধান নিয়ে কথাবার্তা বলছেন, তাঁদের মত প্রকাশ করছেন। মূল দুই নেত্রীও কথা বলছেন। তার মানে সংলাপ চলছে। কিন্তু একটি জাতীয় দৈনিক ভালো শিরোনাম করেছে, ‘সংলাপ মুখেই, উদ্যোগ নেই’।

চার.
এ কথা বলা যায় যে সংলাপ চলছে এবং মূল দুই নেত্রী সেই সংলাপে অংশ নিচ্ছেন। কিন্তু সেটা আনুষ্ঠানিক নয়। আনুষ্ঠানিক সংলাপ শুরুর আগে প্রস্তুতি চলছে। এই কয় দিন আগে অনুষ্ঠিত জব্বারের বলী খেলা অনুষ্ঠিত হলো। বলীদের একজন আরেকজনকে আক্রমণের আগে চারদিকে হেঁটে বেড়ায়, উরু থাবড়ায়, হাঁকডাক মারে। সংলাপও অনেকটা সে রকম। উভয় পক্ষ যখন মনে করবে যে জেতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তখন খেলাটা শুরু হবে।
ইতিমধ্যে দেশের মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধান এবং বিএনপির ৩৩ জন নেতার গ্রেপ্তার নিয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তা অবশ্যই উদ্বেগজনক ছিল। রাত ১২টায় শিক্ষার্থীদের এ-লেভেল পরীক্ষা দিতে যেতে হয়েছে, শুক্রবার ছুটির দিনে স্কুল খোলা রাখতে হয়েছিল। এ পরিস্থিতি জনগণকে উদ্বিগ্ন করবেই। কী কারণে জানি না, বিএনপি আপাতত আন্দোলনে ক্ষ্যামা দিয়েছে। কিন্তু তারা এ ঘোষণাও দিয়েছে যে পূর্বঘোষিত আলটিমেটাম অনুযায়ী, ১০ জুনের মধ্যে সরকারপক্ষ কার্যকর উদ্যোগ না নিলে তারা আবার আন্দোলন শুরু করবে।
সাংবাদিক, সমাজকর্মী, নাগরিকদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে বেশি। আমি বলেছি এ উদ্বেগ স্বাভাবিক। কিন্তু আমি এও বলছি, এই উদ্বেগের কারণে দুই নেত্রী তড়িঘড়ি করে সংলাপে বসবেন না। এর চেয়ে বেশি উদ্বেগ জনগণ, বিশেষ করে অভিভাবকের চোখেমুখে আমি সম্প্রতি দেখেছি। এই উদ্বেগের ছাপ যে দুই নেত্রীর চোখেমুখেও পড়ে তা কখনো মনে হয়নি। যদি হতো তবে তাঁরা তো স্ব-উদ্যোগে একটা কিছু করতেন। নেতা জনগণকে নেতৃত্ব দেন, নাকি জনগণ নেতাকে পরিচালনা করেন? আমাদের দেশে তো সব কিছু উল্টা বইছে। আগে রাজনৈতিক দলের মধ্যে কর্মীরা ছিল দলের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, মূল্যবান সম্পদ। এখন কর্মীরা সব কামলা হয়ে গেছে। নেতা খুশি না থাকলে তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। দ্বিদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল কথা ছিল নিজেদের কাজে-গুণে সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন অর্জনের প্রতিযোগিতা। এখন নেতা আগে দলকে জয় করেন, দলের ওপর তাঁর একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন এবং অতপর জনগণের ওপর খবরদারি করেন। আগে প্রতিযোগিতা ছিল ওই দলের চেয়ে আমার দল কত ভালো, আর এখন জনগণকে ধমক দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আমাদের চেয়ে ওরা কত খারাপ। এ জন্যই জনগণের তোয়াক্কা করার আর কোনো দরকার পড়ছে না।
কেউ কেউ আছেন যাঁরা মনে করেন বুঝিয়ে-সুঝিয়ে দুই নেত্রীকে সংলাপে বসাতে হবে। তাঁরা ভুলের স্বর্গে বাস করেন। এখন বরং কাজ হলো জনগণকে বাস্তব পরিস্থিতি বোঝানো। তাদের সংঘবদ্ধ করা। জনগণের পক্ষ থেকে তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। তাদের বলা, দেখো তোমরা দুটি দল আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয়। কিন্তু তোমাদের গণতান্ত্রিক হতে হবে। যুক্তি মানতে হবে, জেদ করলে চলবে না। আমরা তোমাদেরই সঙ্গে আছি। কিন্তু তোমরা যদি মনে করো, তোমরাই সবচেয়ে ক্ষমতাশালী, তাহলে তোমরা ভুল করছ। আমরা অর্থাৎ জনগণই সব ক্ষমতার মালিক, আমাদের সঙ্গে চালাকি করে, আমাদের উপেক্ষা করে, অবজ্ঞা করে যদি আমাদের কষ্ট দিতে চাও, তাহলে আমরা আমাদের কথা ভাবব, তোমাদের কথা ভাবব না।
মাহমুদুর রহমান মান্না: রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক।